টাঙ্গাইলের চারান বিল, চাপড়া, মলাদহ, ঝাইতলা, বরকম, পুঁইটা, নেধার বিল সহ বিভিন্ন খাল-বিল জলাধারে এখন অতিথি পাখির কলকাকলীতে মুখর। দেশি-বিদেশি পাখির কিচিরমিচির ডাক ও ঝাঁক বেঁধে আকাশে ওড়ার বিমোহিত দৃশ্য দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। জেলার খাল-বিল ও জলাশয়ে এ অপরূপ দৃশ্য অবলোকনে প্রকৃতিপ্রেমিদের ভিড় বাড়ছে। কিন্তু বেরসিক শিকারীরা বিশেষ কায়দায় ‘বিষটোপ’ ব্যবহার সহ নানাভাবে এসব পাখি শিকারে মত্ত হওয়ায় পাখিরা নিরাপত্তহীনতায় পড়েছে।
জানা যায়, শীতকালে উষ্ণতার খোঁজে শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের জলাধারগুলোকে নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বেছে নেয় পরিযায়ী পাখিরা। সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বিলগুলো যেন শীতের অতিথিদের বরণ করে নিতে বাৎসরিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। এবারও বিলের কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদের মাঝে খোলা পানিতে জলকেলিতে মেতে উঠেছে পাখিরা। একটু থেমেই এক ঝাঁক পাখি পানিতে অবতরণ করছে তো আর এক ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলায় ১০৪৩ দশমিক ৫০ হেক্টর আয়তনজুড়ে ১২৮টি খাল, ৬৮০৮ দশমিক ৩৪ হেক্টর আয়তনজুড়ে ২৭৭টি বিল, ১০১৫ দশমিক ৭৪০ হেক্টর আয়তনে ৮২টি জলাশয় রয়েছে। এছাড়া ৪৮ দশমিক ৩৩ হেক্টর আয়তনে ১৭২টি প্লাবন ভূমি আছে।
টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার চর নিকলা বিল, কয়েড়া ধোপাচড়া বিল, আমুলা বিল, বর্ণিবিল, বার্থাবিল, বালিয়া বিল, নিরাইল বিল, চারান বিল, দোগাঙ্গীবিল, মলাদহবিল, ঝাইতলাবিল, বরকমবিল, পুঁইটাবিল, ধোপারকমবিল, খৈইলাকুড়িবিল, আদমবুইড়াবিল বিভিন্ন খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমিতে শীত মৌসুমে দেশি পাখির সঙ্গে পরিযায়ী পাখি এসে যোগ দেয়।
স্থানীয় বোরো ধানের খোলা মাঠে বা জলাধারের কিনারে অল্প পানিতে মাছ শিকারের জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে কানিবক, গো-বক, ছোট সাদা বক, বেগুনি বক, বড় বক, নিশি বক, বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, পানকৌড়ি, শামুককনা, গাঙ কবুতর, মানিকজোড় সহ নানা ধরনের দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি শীত মৌসুমে খেলা করে।
তবে এক শ্রেণির শিকারী অভিনব কায়দার ‘বিষটোপ’ সহ নানা ফাঁদে ফেলে এসব পাখি শিকারে মত্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ এসব পাখি শিকার করে স্থানীয় মাংশাসীদের কাছে চড়াদামে বিক্রি করছে। ফলে জেলার খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমিগুলোতে প্রতিবছর পরিযায়ী পাখির বিচরণ কমছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিকারীরা ছোট মাছের পেটে বাসুডিন, ফুরাডান ও কার্বোটাফ নামে এক ধরনের বিষ ঢুকিয়ে খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমির পাশে বা খোলা মাঠে ছিটিয়ে রাখা হয়। এটাকেই ‘বিষটোপ’ বলা হয়। এসব বিষ মেশানো মাছ খেয়ে দেশি-বিদেশি পাখিগুলো অচেতন হয়ে পড়ে। শিকারীরা সেগুলো ধরে নিয়ে হাটবাজার ও স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে দেয়।
এছাড়া পুঁটি মাছের পেটে বিষ দিয়েও নির্বিচারে বক পাখি শিকার করা হয়। বিষটোপ খেয়ে বক ও অতিথি পাখিরা অচেতন হয়ে পড়লে শিকারীরা দৌঁড়ে গিয়ে ধরে সাথে সাথে জবাই করেন। পরে ওই পাখি দিয়ে ভুড়ি ভোজের আয়োজন করে বা স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে থাকেন।
আবার নাইলনের সুতোর তৈরির ফাঁদ ও বাটাল দিয়েও পাখি শিকার করা হচ্ছে। জেলাজুড়ে প্রকাশ্যে এসব পাখি শিকার করা হচ্ছে। শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জেলায় পাখি শিকার ও বিক্রেতার সংখ্যাও বাড়ছে।
১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণি রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের জেল বা এক লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার কথা বলা হয়েছে। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে একাধিক শিকারী জানান, প্রতিবছর শীত মৌসুমে শখের বসে খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বক, ঘুঘু, বালিহাঁস, পানকৌড়ি, শামুককনা শিকার করে থাকেন তারা। এগুলো তারা বিষ জাতীয় দ্রব্য বা বাটালের মাধ্যমে শিকার করেন। তবে বিষ খেয়ে অসুস্থ ও বাটালের মাধ্যমে ছোঁড়া মারবেলের আঘাতে আহত হয়ে মাটিতে অচেতন হয়ে পড়লে তারা ধরে সঙ্গে সঙ্গে জবাই করেন। শিকার করা বক পাখির আকার ভেদে প্রতিটি ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. সুজাউদ্দিন তালুকদার জানান, পাখি শিকারের জন্য যে বিষটি ব্যবহার করা হয় তা ওপিসি জাতীয় বা গণ ফসফরাস কমপাউন্ড জাতীয় এক ধরণের বিষ। এটা কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটা মানুষের দেহে স্কীনের উপর দিয়ে ঢুকতে পারে, খাবারের মাধ্যমে এবং শ্বাসনালীর মাধ্যমেও ঢুকতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে এটা স্কীনের উপরে থাকলে রক্তের সাথে মিশে যেতে পারে।
তিনি আরও জানান, বিষটোপে শিকার করা এসব পাখি মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ বিষের মাত্রা যদি বেশি থাকে তাহলে মানুষ মারা যেতে পারে। না হলে অল্প সময়ের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হতে পারে। যেমন বমি হতে পারে, প্রেসার কমে যেতে পারে, কিডনি এবং লিভারের ক্ষতি হতে পারে। এ ধরণের বিষ দিয়ে শিকার করা পাখি কখনই খাওয়া যাবে না- কোনোভাবেই এটা নিরাপদ হবে না। আগুনে ফুটালেও এ বিষ যাবেনা।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (ইএসআরএম) বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর এএসএম সাইফুল্লাহ জানান, একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে- শুধুমাত্র মধুপুর জাতীয় উদ্যানে ১৪০ প্রজাতির পাখির উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। যার অনেক বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। এভাবে চলতে থাকলে অনেক পাখির প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য ও জীব বৈচিত্রের ওপর।
টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান জানান, যেসব এলাকায় পাখি শিকার করা হচ্ছে সে অঞ্চলে বনাঞ্চল না থাকায় তাদের তেমন একটা নজরে আসে না। তাছাড়া তাদের জনবল খুব কম থাকায় যথা সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না। তবে যারা পাখি শিকার করে অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য