প্রায় প্রতি বছরই হাওরে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে বোরো ধান গোলায় তুলতে পারে না কৃষক। এবারও অনিশ্চয়তা থাকায় এবং ধানের ন্যায্যমূল্যে না পাওয়ার আশঙ্কায় ভুট্টা চাষে ঝুঁকছে কৃষক। ফলে কিশোরগঞ্জের হাওরের উপজেলা ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, করিমগঞ্জ, বাজিতপুর, তাড়াইল ও নিকলীর বিস্তীর্ণ এলাকার বোরো জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া ভুট্টাক্ষেত দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।
কৃষকরা জানান, বোরোর উৎপাদন ভালো হলেও অন্তত প্রতি তিন বছরে একবার ধান গোলায় তুলতে না পারা যেন নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে এক বছরের ফসলহানি চার বছরেও পুষিয়ে নেওয়া যায় না। তাছাড়া বোরো চাষে উৎপাদন খরচ বেশি ও ফলন কম। ধানের দাম কম হওয়ায় হাওরের উপজেলাগুলোতে এবার অনেকে বোরো ধানের আবাদ কমিয়ে দিয়েছেন। অধিক লাভের আশায় ভুট্টার চাষ বেশি করছেন।
বিভিন্ন উপজেলার অর্ধশতাধিক কৃষক জানান, বোরো ধানের আবাদ করে কোনো রকমে উৎপাদন খরচ উঠলেও গত কয়েক বছর তাদের উল্লেখযোগ্য লাভ হচ্ছে না। বোরো আবাদের সময় ধানের বীজ, বীজতলা তৈরি, সার, কৃষি শ্রমিক, কীটনাশক, জমিতে পানি দেওয়া, ধান কাটা ও ধান মাড়াই মিলে প্রতি একরে (১০০ শতাংশ) খরচ হয় ৩৩ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। একর প্রতি ধানের ফলন হয় ৬৫ থেকে ৭৫ মণ। ওই ৭৫ মণ বোরো ধান বাজারদরে বিক্রি করে পাওয়া যায় ৪০-৪৫ হাজার টাকা। এতে লাভের পরিমাণ খুবই কম। আর দুর্যোগ হলে তো কথাই নেই।
নিকলী উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘বোরো ধানের আবাদ কমে গিয়ে বেড়েছে ভুট্টার চাষ। গত বছর উপজেলায় ভুট্টার চাষ হয়েছিল প্রায় ৫ হাজার একর জমিতে। এবার জমির পরিমাণ আরও বেড়েছে।’
উপজেলার বড়হাটি গ্রামের সুলতান মিয়া বলেন, ‘গত মৌসুমে ১০ একর জমিতে বোরো ধানের ফলন হয়েছে ৬০০ মণ। বৈশাখ মাসে বাজার দরে বিক্রি করে পেরেছি ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকায়। ১০ একর বোরো জমিতে ধান ফলাতে উৎপাদন খরচ হয়েছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এতে লোকসান হয়েছে ২০ হাজার টাকা। সে কারণে বোরো ধানের জমিতে ভুট্টার আবাদ করছি।’
ঘোড়াদিঘা গ্রামের কৃষকরা জানান, কয়েক বছর বোরো ধানের চাষ করে এলাকার কৃষকরা লোকসান গুনেছে। এ বছর তারা তাদের ধানের জমিতে ভুট্টা চাষ করেছে। প্রতি একরে ৯০ মণ করে ভুট্টা হবে আশা করছে। সব খরচ বাদ দিয়েও প্রতি ১০ একরে ৩ লাখ টাকা লাভ হবে। ফলে এলাকার অনেক কৃষক তাদের ধানের জমিতে ভুট্টা চাষ করেছে।
বাজিতপুরের মাইজচর গ্রামের কৃষক তাহের মিয়া বলেন, ‘ভুট্টা চাষে লাভ বেশি। কারণ ভুট্টা ধানের এক মাস আগে তোলা যায়। এ সময় কৃষি শ্রমিকের মজুরি থাকে কম।’
ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রাফিউল ইসলাম বলেন, ‘ধান চাষের চেয়ে ভুট্টা চাষে খরচ কম, লাভ হয় বেশি। সে কারণে স্থানীয় কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভের কথা চিন্তা করেই ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়েছে। বোরো ধানের চাষ করে চাষিরা লাভের মুখ না দেখায় এ বছর সাড়ে পাঁচ হাজার একর জমিতে ভুট্টা আবাদ হয়েছে।’
মিঠামইন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জ্বল সাহা একই অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘এবার ইটনায় প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে নতুন করে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। দিন দিন হাওরে ভুট্টার চাষাবাদ বাড়ছে। ফলে হাওরের কৃষকদের স্বাবলম্বী হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
হাওরের উপজেলাগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য চাষ, লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগির ফার্ম ও গরু মোটাতাজাকরণের জন্য স্থানীয়ভাবেও ভুট্টার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন ফিড মিলের মালিকরা ভুট্টা তোলার পর হাওরের বিভিন্ন মোকাম থেকেই নিয়ে যান। তাই দাম বিক্রি নিয়ে কৃষকের বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয় না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুস সাত্তার বলেন, এবার গোটা হাওরে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ একর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। ভুট্টা আবাদে হাওরে কোনো ঝুঁকি নেই, উৎপাদন খরচ কম আবার দামও ভালো পাওয়া যায়। পাশাপাশি বোরো উৎপাদনের এক মাস আগে ভুট্টা মাড়াই ও গুদামজাত করা যায়। তাই দিনে দিনে ভুট্টার প্রতি ঝুঁকছে হাওরের কৃষক। এবার ভুট্টার বাম্পার ফলনের পাশপাশি দামও ভালো পাবেন। অধিকাংশ পতিত জমি এবার ভুট্টা চাষাবাদের আওতায় আসায় হাওরে এক ফসলি জমির দুঃখ ঘুঁচেছে কৃষকের।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য