কক্সবাজারের সাগর উপকূল ও নাফনদীসহ ২৫ পয়েন্ট দিয়ে মায়ানমারে পাচার হচ্ছে জ¦ালানী, ভোজ্যতেল, ঔষধসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য। আর মায়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা ও আইস। বন্ধ হয়ে গেছে সীমান্ত বানিজ্য। সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের অভিযানে মায়ানমারে পাচারকালে ধরা পড়েছে জ¦ালানি তেল, ভোজ্যতেল, ঔষধ, পেঁয়াজ, চালসহ নিত্যপণ্য।
গত বছরের ১৩ নভেম্বর থেকে মায়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হন বিদ্রোহী আরকান আর্মির সৈন্যরা। এরপর থেকে টেকনাফ স্থল বন্দরে সীমান্ত বানিজ্যে নামে ধস। মায়ানমারের শান কাচিন, কারেন্ট, ইয়াঙ্গুন ও রাখাইনসহ সাতটি প্রদেশে চলা সশস্ত্র গৃহযুদ্ধের প্রভাবে সেখানকার খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশের সড়ক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।
এদিকে সীমান্ত এলাকা সফরে এসে কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে সবধরনের পণ্য পাচার বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের ডিআইজি নূরে আলম মিনা।টেকনাফ কোস্ট গার্ডের স্টেশন কমান্ডার এইচ এম লুৎফুল লাহিল মাজিদ বলেন, এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের বিপরীতে মাদকদ্রব্য দেশে ঢোকার প্রচেষ্টা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোস্টগার্ড অতন্দ্র সীমান্তের প্রহরী হিসাবে কাজ করছে।
সীমান্ত ব্যবসায়ী আবদল আলিম বলেন,বাংলাদেশের ১৫০ টাকার প্রতিলিটার ভোজ্য তেল মায়ানমারের এসব রাজ্যে এখন ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
টেকনাফ স্থল বন্দরের পরিচালনায় দায়িত্বে নিয়োজিত ইউনাইটেড টেকনাফ লি. এর মহাব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, গত বছর নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মায়ানমারে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এর চরম প্রভাব পড়েছে সীমান্ত বানিজ্যে। ডিসেম্বর থেকে ক্রমাগতভাবে কমতে থাকে আমদানি রপ্তানি। বর্তমানে সীমান্ত বানিজ্য একেবারে বন্ধ। টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে আদা রসুন, পিঁয়াজ, মাছ, কাঠ, আচার, মশলা, নারিকেল ও ইলেকট্রনিকপণ্যসহ বিভিন্ন মালামাল আসতো। এসব পণ্য আসা এখন শূন্যের কোঠায়।
বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ থেকে ঔষধ আলু, খেলনা, প্লাস্টিক সামগ্রী, পোশাক, চিপস, অ্যালুমিনিয়াম, প্রসাধনী ও বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী রপ্তানি হতো। এখন বৈধ পথে তা বন্ধ থাকলেও অবৈধ পথে চড়া মূল্যে যাচ্ছে মায়ানমারে যুদ্ধবিধ্বস্ত ৭টি প্রদেশে।
ইউনাইটেড ল্যান্ডপোর্ট লি. এর মহা ব্যবস্থাপক আরো জানান, টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে ঋণপত্র (এলসি) ব্যবস্থায় আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম হয়না। দু দেশের সীমান্ত বানিজ্য পরিচালিত হয় ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে। মায়ানমারে ব্যাংকগুলো অধিকাংশই বন্ধ। তাই চাইলে ও ব্যাংক ড্রাফট করা যাচ্ছে না। তবে সর্বশেষ গত ৬ ফেব্রুয়ারী নারিকেল, শুটকিসহ অন্যান্য পণ্য নিয়ে একটি ট্রলার চরম ঝুঁকি নিয়ে টেকনাফ বন্দরে এসেছে বলে জানিয়েছেন জসিম।
সর্বশেষ ১২ ফেব্রুয়ারী টেকনাফ সাগর উপকূল দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ‘মিয়ানমারে পাচারের উদ্দেশ্যে মজুদকালে’ বেশ কিছু পরিমান ঔষুধ ও খাদ্যপণ্যসহ পরিবহনকাজে ব্যবহৃত গাড়ী জব্দ করেছে র্যাব। এসময় পাচারকাজে জড়িত থাকার অভিযোগে দুইজনকে আটক করা হয়েছে।
র্যাব জানিয়েছে, মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী আরকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘাতের জেরে দেশটির রাখাইন রাজ্যে ঔষুধ, জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে একটি অসাধু ব্যবসায়ি চক্র বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন চ্যানেল ব্যবহার করে উচ্চমূল্যে এসব পণ্য ও মালামাল পাচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে সরকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি দেশের স্থানীয় বাজারে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে।
মঙ্গলবার দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানান র্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। আটকরা হলেন, টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের হাতিয়ারঘোনা এলাকার আব্দুল মান্নান এবং একই এলাকার আলী হোসেন।
সোমবার রাতে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাতিয়ারঘোনা এলাকায় জনৈক আবুল বশরের বাড়ীতে সংঘবদ্ধ পাচারকারি চক্রের কতিপয় লোকজন বেশ কিছু পরিমান পণ্য প্রতিবেশী দেশে পাচারের জন্য মজুদ করেছে খবরে র্যাবের একটি দল অভিযান চালায়। এতে র্যাব সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে ৪/৫ জন লোক দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে। পরে ধাওয়া দিয়ে দুইজনকে আটক করতে সক্ষম হলেও অন্যরা পালিয়ে যায়। এসময় আবুল বশরের মুরগীর খামারে মজুদ করা অবস্থায় পাওয়া যায় ৪ হাজার ৪৭০ লিটার সয়াবিন তেল, ৫০০ কেজি ময়দা এবং ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৫০ টি বিভিন্ন ধরণের ঔষুধ।
চক্রটি মিয়ানমারে নিত্যপণ্যের বিনিময়ে বাংলাদেশে মাদকের বড় বড় চালান নিয়ে আসছিল বলে গ্রেপ্তাররা র্যাবের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছে বলে জানান, খন্দকার আল মঈন। দেশের পণ্য রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মায়ানমারে পাচার হয়ে যাক সেটা কোন অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য