লক্ষ্মীপুরকে বলা হয় সয়াল্যান্ড। রবি মৌসুমে উপকূলীয় এ জেলার চরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে সয়াবিনের আবাদ হয়। ফলনও ভালো হয়। সয়াবিনের পাশাপাশি বোরো ধান এবং সবজির আবাদ করেন কৃষকেরা।
তবে ব্যতিক্রম চিত্র দেখা গেছে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের চরউভূতি গ্রামে। ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলভীরহাট, বয়ার চর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকায় ফসলি জমি অনাবাদি পড়ে আছে এবার। মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গত ১০ বছর ধরে অন্তত ৩ শতাধিক একর জমিতে রবি মৌসুমে কোনো শস্য আবাদ হয় না। তবে কিছু কিছু জমিতে সয়াবিনের আবাদ করলে ঝলসে যাচ্ছে সয়াবিনের কচি গাছ। এতে লোকসানে পড়ছেন কৃষকরা। ফলে আবাদে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন তারা।
এদিকে ফসল উৎপাদন না হওয়ায় জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। ফসল না হওয়ার পেছনে লবণাক্ততার পাশাপাশি ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও অতিরিক্ত তাপমাত্রাকেও দোষ দিচ্ছেন স্থানীয়রা।
এসব এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ জমি খালি পড়ে আছে। ওইসব জমির মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে পাশের ইটভাটাগুলোতে। সামান্য কিছু জমিতে সয়াবিন চাষ করা হয়েছে। কিন্তু খেতে চারা গজানোর হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মতো। আবার খেতের কচি চারাগুলো হলুদ বর্ণ ধারণ করে মরে যাচ্ছে। ক্ষেতের আইল বা অনাবাদি জমির বিভিন্ন স্থানে সাদা সাদা লবণের দাগ দেখা গেছে।
শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ত জমিতে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করা যাবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন, কৃষক ও কৃষি বিভাগ।
তেওয়ারীগঞ্জের ৯ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) জাফর আহম্মদ চলতি মৌসুমে ২ একর জমিতে সয়াবিনের বীজ বুনেছেন। বীজ থেকে চারা গজালেও একটু বড় হওয়ার পর কচি চারাগুলো মারা যাচ্ছে।
কৃষক মাহফুজুর রহমান বলেন, ৪০ শতাংশ জমিতে সয়াবিন চাষ করেছি। অর্ধেক জমির চারা গজিয়েছে। চারাগুলো এখন হলুদ বর্ণ ধারণ করে মরে যাচ্ছে। তবে কিছু কিছু জমিতে আমন ধান ভালো হয়েছে। কিন্তু অনেক জমির মাটি কেটে নিচু করা হয়েছে। তাই আমনের মাঝামাঝিতে ওপরের জমিগুলোতে পানি থাকে না। তখন ওইসব জমির আমন ধানও ভালো হয় না।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. সোহেল রানা বলেন, একদিকে জমিতে লবণ, অন্যদিকে একটি এলাকায় ৮ থেকে ১০টি ইটভাটা রয়েছে। এ দুই কারণে এ এলাকায় কৃষিতে বিপর্যয় ঘটেছে। ৩০০ একরের বেশি জমি অনাবাদি পড়ে আছে।
স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক সানা উল্যাহ বলেন, শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাছাড়া এ এলাকায় অনেকগুলো ইটভাটা রয়েছে। ফলে ভাটা থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ড্রাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। বিষাক্ত এসব গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। কুয়াশা বা হালকা বৃষ্টির পানির সঙ্গে এ গ্যাসগুলো বিক্রিয়া করে এসিডে পরিণত হয়। এসিড বৃষ্টির ফলে ওই এলাকার ফসলি মাঠের ফসলসহ গাছপালার মারাত্মক ক্ষতি হয়। কিন্তু এসব বিষয়ে কৃষি বিভাগসহ প্রশাসনের নজরদারি নেই। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান এ স্কুল শিক্ষক।
লবণাক্ততার কারণে ফসলের বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে ওই এলাকার দায়িত্বরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রাকিব বলেন, জমিতে লবণের পরিমাণ বেশি। ফলে কোনো ফসল হয় না। এ জন্য কৃষকেরা জমি খালি রেখে দেন। লবণাক্ত জমিতে জৈব সারের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম সালফেট প্রয়োগ করলে লবণের মাত্রা কিছুটা কমে।
সেচের বিষয়ে তিনি বলেন, একটি খাল আছে, সেটি বিভিন্ন স্থানে দখল হয়ে আছে। এটি সংস্কার করে পানি আনার ব্যবস্থা করলে অনাবাদি এসব জমি বোরো চাষাবাদের আওতায় আসত। কিন্তু খাল খনন বা সেচের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করর্পোরেশন (বিএডিসি) দেখে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, আমন ধান কাটার আগেই বিনাচাষে জমিতে সয়াবিন বীজ বপন করা যায়। তাহলে জমি শুকানোর আগেই সয়াবিন গাছ বড় হয়ে যাবে। গাছের পাতা গজালে সরাসরি মাটিতে রোধের আলো কম পড়বে। এতে লবণের তীব্রতা কম দেখা দেবে। লবণের জমিতে বেশি পরিমাণে ভার্মি কম্পোস্ট বা জৈব সার ব্যবহার করার পরামর্শ দেন এ কৃষি কর্মকর্তা।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য