-->
শিরোনাম

জমি অধিগ্রহণে আটকে আছে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর কার্যক্রম

শিরিন জামান, চুয়াডাঙ্গা
জমি অধিগ্রহণে আটকে আছে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর কার্যক্রম
ক্যাপশন: রাজস্ব ক্ষেত্র ও সম্ভাবনাময় বাণিজ্য কেন্দ্র দর্শনা স্থলবন্দর

চুয়াডাঙ্গা জেলার শিল্প শহর হিসাবে খ্যাত দর্শনা। পুর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর বাস্তবায়নের কার্যক্রম দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে বন্দর এলাকায় ওয়ার হাউ, রেল ইরার্ড শেড, ট্রাক টার্মিনাল, আবাসিকসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মানের জন্য সাড়ে ৪শ’ বিঘা জমি অধিগ্রহনের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই, দাগসুচি প্রনয়ন, প্রস্তাবিত দাগ মৌজা ম্যাপে চিহ্নিতকরনের কাজ সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। এখন দ্রুত এই জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হলেই শুরু হবে দর্শনা স্থলবন্দর কার্যক্রমের কাজ।

 

এশিয়ান ডেভোলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)’র সাসেক (সাউথ এশিয়ান সাব-রিজিয়ন্যাল ইকোনোমিক্যাল কো-অপারেশন) প্রোগ্রামের আওতায় শুরু হতে যাচ্ছে দর্শনা স্থলবন্দর উন্নয়নের কাজ। আপাতত হালকা যানে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রজ্ঞাপন (এসআরও) সংশোধন ও সীমান্তের শুন্যরেখা পর্যন্ত ১ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ সম্পন্ন করেছে ভারত। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সংগঠন চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কর্মার্স এ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি’র আবেদনের প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে দর্শনা বন্দর দিয়ে রেলপথের পাশাপাশি সড়ক পথে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালু করতে এসআরও সংশোধন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

 

সাবেক এনবিআর’র চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া ২০১৮ সালের নভেম্বরে এ সংক্রান্ত পত্র ভারতের দিল্লীতে প্রেরণ করেছেন। এতে ভারতেরও প্রচন্ড আগ্রহ রয়েছে। এ লক্ষে ওই বছর ১৩ ডিসেম্বর গেঁদে-দর্শনা বন্দর এলাকা পরিদর্শন করেন, ইন্ডিয়া ল্যান্ড পোর্ট অথরিটির চেয়ারম্যান ও বর্ডার ম্যানেজমেন্ট সেক্রেটারি মি.এন এন সিনহা। এর আগে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তীও এ বন্দর এলাকা পরিদর্শন করেন। এরপরের চেয়ারম্যান কেএম তারিকুল আলম ও মো. আলমগীর হোসেন এ বন্দর এলাকা পরিদর্শন করেন।

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সম্ভাবনাময় নতুন নতুন রাজস্ব ক্ষেত্রে অনুসন্ধানে ২০১৭ সালের ১২ জুলাই দর্শনায় আসেন তৎকালীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান। এলাকার সকলের অংশগ্রহণে দর্শনা অডিটেরিয়ামে আয়োজিত মতবিনিময়সভায় তিনি বলেন-‘দর্শনা স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে রেলথের পাশাপাশি সড়ক পথে দর্শনা-গেঁদে সীমান্ত পথে পণ্য আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে স্থল শুল্ক স্টেশন দর্শনায় একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালু হবে অচিরেই।’

 

বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যান মো. রাহমাতুল মুনিমও এ বন্দর পরিদর্শন করে একই অভিমত ব্যক্ত করেন। এছাড়াও এ বন্দর পরিদর্শন করেছেন ভারতের দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার মোহাম্মদ ইমরান। সর্বশেষ গত ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর বন্দর এলাকা পরিদর্শন করেন। বিগত সরকারের বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনসি ও শিল্প মন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ন এ বন্দর এলাকা পরিদর্শন করেন।

 

এরপর ২৬ থেকে ৩০ ডিসেম্বর’২০২১ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত দু’দেশের স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সাব গ্রুপের মিটিংয়ে দ্রুত গেঁদে-দর্শনা স্থলবন্দর দিয়ে সড়ক পথে আমদানি-রপ্তানি বানিজ্য চালুকরনে একমত পোষন করে দু’দেশের চলমান কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়াও ২৭ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২৩ দিল্লীতে অনুষ্ঠিত জয়েন্ট কাস্টমস গ্রুপের মিটিংয়ে গেঁদে (ভারত) দর্শনা (বাংলাদেশ) স্থলবন্দর দিয়ে সড়ক পথে এই মুহুর্তেই হালকা যানে আমদানি-রপ্তানি বানিজ্য চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

 

দর্শনায় ১৯৬২ সাল থেকে রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানী কার্যক্রম শুরু হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রজ্ঞাপন নং-০১-আইন/২০১৫/২৫২৬/শুল্ক ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি মোতাবেক ভারত থেকে রেলপথে দর্শনা শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে গবাদিপশু, মাছের পোনা, তাজা ফলমূল, গাছগাছড়া, বীজ গম, পাথর, কয়লা, রাসায়নিক সার, চায়না ক্লে, কাঠ টিম্বার, চুনাপাথর, পিয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, বলক্লে, কোয়ার্টজ, চাল ভূষি, ভুট্টা, বিভিন্ন প্রকার খৈল, পোল্ট্রি ফিড, ফ্লাই অ্যাশ, রেলওয়ে স্লিপার, বিল্ডিং স্টোন, রোড স্টোন, স্যান্ড স্টোন, বিভিন্ন প্রকার ক্লে, গ্রানুলেটেড ও জিপসামসহ ৩৬টি পন্য আমদানি এবং সকল প্রকার পন্য রপ্তানীর অনুমোদন আছে এবং কার্যক্রম চলছে।

 

২০১৬ সালে দর্শনা স্থল বন্দরে আমদানি-রপ্তানির সকল পদ্ধতি ডিজিটাল সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। দর্শনা স্থলবন্দর শুল্ক স্টেশনে চালু করা হয়েছে এ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড। এর ফলে দেশের যে কোন বন্দর থেকে মুহুর্তেই দর্শনা বন্দরের আমদানি-রপ্তানিকৃত সকল পণ্যের এসএম কোর্ড ও মুল্য নির্ধারন সুবিধা পাবেন ব্যবসায়ীরা। চট্রগ্রাম, টেকনাফ, মংলা, বেনাপোল বন্দরের পর দর্শনা বন্দরে চালু হয়েছে এই সার্ভারটি।

 

দর্শনায় রয়েছে ৪৫ বিঘা জায়গার উপর কাস্টমস শুল্ক স্টেশনের সকল দপ্তর। শতাধিক সিএ্যান্ড এফ এজেন্ট এর অফিসের পাশাপাশি রয়েছে একাধিক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের শাখা। আরো আছে একটি আন্তর্জাতিক রেলস্টেশন, একটি আভ্যন্তরীণ রেলস্টেশন, একটি ইমিগ্রেশন চেকপোষ্ট, বিজিবির আইসিপি ক্যাম্প, একটি কোম্পানী সদর, আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, পুলিশের থানা ও সার্কেল এসপি’র কার্যালয়।

 

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের টার্মিনাল ওয়্যার হাউজসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য দর্শনা চেকপোষ্টের (জয়নগরে) ১৬৭.৪৫ একর জমি অধিগ্রহণ করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে। সেই সাথে সড়ক ও জনপদ বিভাগ দর্শনা-চুয়াডাঙ্গা সড়কের ফায়ার সার্ভিসের কাছে প্রধান সড়কের দু’পাশে ২৫ বিঘা জমির উপর আধুনিকমানে ওয়ে ব্রীজ স্কেল বসানোর কাজ শুরু করেছে।

 

দর্শনা থেকে দৈনিক ৫০টি যাত্রীবাহী কোচ হাইওয়ে রোড দিয়ে ঢাকা ও চট্ট্রগ্রাম যাতায়াত করে এবং বেনাপোল এক্সপ্রেসসহ রেলপথে ঢাকা, রাজশাহী, সৈয়দপুরে দৈনিক ১০টি ট্রেন যাতায়াত করে। ভারত বাংলাদেশ অর্থ্যাৎ ঢাকা-কলকাতার মধ্যে একমাত্র চলাচলকারী যাত্রীবাহি ট্রেন ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’ চলাচল করে দশর্না-গেঁদে রুটে। ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে এ রুটে সপ্তাহে ৬ দিন চলছে মৈত্রী ট্রেন।

 

বন্দরের চেকপোস্ট থেকে আঞ্চলিক মহা সড়ক পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার ১৮ ফুট চওড়া পাকা সড়ক বিদ্যামান। দর্শনা বন্দরের চেকপোস্ট পয়েন্ট থেকে কুষ্টিয়া চার লেন সড়ক পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার সড়র চার লেনে উন্নীতকরনের প্রকল্প চলমান রয়েছে। দর্শনার জয়নগরে রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট। এখান থেকে বর্তমানে প্রতিদিন ২ হাজার পাসপোর্টধারী যাত্রী সড়ক পথে বাংলাদেশ-ভারত ভ্রমন করে থাকেন।

 

রাষ্ট্রপতির আদেশ ক্রমে চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা স্থল শুল্ক স্টেশনকে ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়। উদ্দেশ্য হলো-এ সীমান্ত দিয়ে আমদানি-রপ্তানী বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সহজীকরন।

 

স্থল বন্দর বাস্তবায়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম বলেন, রেলপথ ও সড়ক পথ মিলিয়ে দর্শনায় একটি আধুনিকমানের স্থলবন্দর নির্মান এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশের ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা মুখিয়ে আছেন এ বন্দর দিয়ে ব্যবসা করার জন্য। দর্শনা বন্দর দিয়ে দ্রুত সড়ক পথে বানিজ্য চালু হলে চাপ কমবে পার্শবর্তী বেনাপোল বন্দরের উপর। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ বন্দর খুলে দেবে দু’দেশের বানিজ্যের দ্বার। মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বেড়ে যাবে বহুগুন।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version