-->
শিরোনাম

অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ফার্মেসি

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি
অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ফার্মেসি
ক্যাপশন: রূপগঞ্জের একটি ফার্মেসি

রূপগঞ্জে প্রশিক্ষিত ফার্মাসিষ্ট ছাড়াই গোটা উপজেলার অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে আড়াই হাজারের বেশি ফার্মেসি। ঔষধ প্রশাসনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছে ওষুধ বিক্রির ব্যবসা। এসব ফার্মেসি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক, নিষিদ্ধ, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের বিভিন্ন ওষুধ বিক্রি করছে অবাধে। এতে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেক রোগী ও তাদের পরিবার। এখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। ফলে রূপগঞ্জের ১০ লাখ বাসিন্দা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।

 

এছাড়া ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে- বেশ কিছু ওষুধের দোকানে ওষুধ ব্যবসার আড়ালে ঘুমের ট্যাবলেট ও ইয়াবা বিক্রি করে বলে জানা গেছে। নারায়ণগঞ্জ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, রূপগঞ্জে নিবন্ধিত ফার্মেসি রয়েছে ৪৩৬টি। তবে নিবন্ধন ছাড়া কতগুলো ফার্মেসি আছে, তার সঠিক হিসাব দিতে পারেননি তারা।

 

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, রূপগঞ্জে প্রায় আড়াই হাজারের উপরে অননুমোদিত ফার্মেসি আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কোনো ফার্মেসিতেই ফার্মাসিষ্ট কিংবা কেমিস্ট নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রূপগঞ্জে কয়েক হাজার ফার্মেসি চলছে লাইসেন্স ছাড়া। এর মধ্যে প্রায় হাজার খানেক দোকান আছে, যেগুলো খুবই নিম্নমানের। স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জামসহ বিভিন্ন ওষুধের চাহিদা বাড়ায় এসব দোকানের ব্যবসাও জমজমাট। তদারকি কম থাকায় নকল, মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে এসব দোকানে। তবে এসব ফার্মেসিতে ওষুধ মজুত, প্রদর্শন ও বিক্রয় ১৯৪৬ সালের ড্রাগস রুলস অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

 

আবার লাইসেন্সবিহীন অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পাশাপাশি আয়ুর্বেদী ও হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ফার্মেসি খুলে বসেছেন অনেকে। তবে ফার্মেসি পরিচালনার জন্য যে ন্যূনতম যোগ্যতার প্রয়োজন তাও আবার অনেক ফার্মেসি মালিকদের নেই।

 

সরেজমিনে উপজেলার কয়েকটি ফার্মেসিতে গিয়ে জানা যায়, তারা ফার্মেসি ব্যবসা শুরু করার আগে অন্যের ফার্মেসিতে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। সেখান থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজেই শুরু করেছেন ফার্মেসি ব্যবসা।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১০ বছরে ফার্মেসিতে ভুল চিকিৎসায় ৭ জন রোগী মারা গেছেন। ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর যাত্রামুড়া এলাকার তামীন পলি ফার্মেসিতে ভুল চিকিৎসায় শাহনাজ আক্তারের ৪ মাসের যমজ সন্তান মারা যায়। এ ঘটনায় পুলিশ ফার্মেসির মালিক ইয়াছিনকে আটক করেছিল। পরে মামলা না করায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০১১ সালে নগরপাড়া এলাকার খোকন ফার্মেসিতে ভুল চিকিৎসায় এক শিশু মারা যায়।

 

ভুলতা ও গোলাকান্দাই এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ এলাকায় অনেক হাসপাতাল থাকায় ৩৫টির ওপরে ফার্মেসি গড়ে উঠেছে। এগুলোর ওষুধ সংরক্ষণ ব্যবস্থাসহ সার্বিক অবস্থা মানসম্পন্ন নয়। ফার্মেসি চালু করার জন্য বাধ্যতামূলক হচ্ছে, ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে ড্রাগ লাইসেন্স নেওয়া এবং প্রত্যেক ফার্মেসিতে একজন সনদপ্রাপ্ত ফার্মাসিষ্ট থাকা। অথচ বেশির ভাগ ফার্মেসিতেই নেই ড্রাগ লাইসেন্স আর সনদপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন রোগের স্পর্শকাতর ওষুধ বিক্রিরও অভিযোগ আছে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপগঞ্জের গ্রামপর্যায়ে ছোটখাটো ফার্মেসিগুলোতে ওষুধ ব্যবসার আড়ালে ঘুমের ট্যাবলেট ও ইয়াবা বেঁচাকেনা করা হয়। কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নগরপাড়া বাজারে খোকন ফার্মেসিতে ওষুধ ব্যবসার আড়ালে ইয়াবা বেচাকেনা হয় বলে জানা গেছে। এ ফার্মেসির ভুল চিকিৎসায় এক শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

 

কথা হয় অষ্টম শ্রেণি পাস ফার্মেসির মালিক খোকন মিয়ার সঙ্গে। তিনি নিজেকে ডা. দাবি করে বলেন, এসব মিথ্যা কথা। লাইসেন্স ও ফার্মাসিস্ট আছে কি না এ প্রসঙ্গে কথা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। মুড়াপাড়া দড়িকান্দি এলাকায় এক ফার্মেসিতে গিয়ে দেখা যায়, এক পাশে চা দোকান, আরেক পাশে ফার্মেসি ব্যবসা। দোকান মালিক জানান, এসব ফার্মেসিতে অধিকাংশই ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের বাইরে ওষুধ সরবরাহ দিয়ে থাকেন। আর সাধারণ মানুষের ওষুধের মূল্য সম্পর্কে ধারণা না থাকায় ৫ টাকার ওষুধ ২০-৩০ টাকায় বিক্রি করছেন। এ ছাড়া ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে ভালো মানের ওষুধের চেয়ে বেশি কমিশন দেওয়া হচ্ছে। এতে বেশি লাভের আশায় ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছে ওষুধ ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষও কোন ওষুধটি আসল কোনটি নকল তা চিহ্নিত করতে অপারগ। এর ফলে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বাণিজ্য দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফার্মাসিস্ট বলেন, আমি নিজে ড্রাগ লাইসেন্সধারী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট হিসাবে ওষুধের ব্যবসায় যে সুবিধা ভোগ করছি অথচ অনেকেই ড্রাগ আইন না মানা সত্ত্বেও একই সুবিধা পাচ্ছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রূপগঞ্জের অধিকাংশ ফার্মেসিতে ভুয়া ও নিম্নমানের কোম্পানির ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। ওইসব ওষুধে ১০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়ে ওষুধ বিক্রি করা হয়। এসব ওষুধ খেয়ে রোগীরা আরও জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

সরেজমিনে একাধিক ফার্মেসি ঘুরে ভিন্ন এক চিত্র দেখা যায়, ডিগ্রিধারী, ডিপ্লোমাধারী ফার্মাসিস্ট ও ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়াই পুরো উপজেলায় চলছে হাজার হাজার ফার্মেসি। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এসব ফার্মেসি থেকে বিক্রি হচ্ছে ওষুধ। এরমধ্যে অধিকাংশ ফার্মেসিগুলোতে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ছাড়পত্র নেই। এছাড়া বড় বড় ফার্মেসির ড্রাগ লাইসেন্স থাকলেও সেখানে নেই দক্ষ ফার্মাসিস্ট। কোনো ধরনের কেমিস্ট বা ফার্মাসিষ্ট না থাকলেও সব ধরনের রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এসব ফার্মেসিতে প্রায়ই ছোট ছোট অপারেশনও করানো হয়।

 

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. বাদল বলেন, ফার্মেসিগুলো রোগের লক্ষণ দেখে ওষুধ দেয়। রোগটার কারণ কি সেটা দেখে না? এসব ফার্মেসিতে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টোবায়োটিক মিস ইউজ হচ্ছে। হরহামেশা অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে মানুষ কিডনির সমস্যাসহ নানা সমস্যায় ভুগছে। মানুষকে সচেতন হতে হবে।

 

উপজেলা স্বাস্থ্যও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আইভি ফেরদৌস বলেন, খুব শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে। হাসপাতালগুলোতে অভিযান চলছে। এরপরই অননুমোদিত ফার্মেসিতে অভিযান চালানো হবে।

 

নারায়ণগঞ্জ জেলা ঔষধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক এস এম সাবরীনা ইয়াছমিন বলেন, অভিযান শুরু হয়েছে। জেলা শহরে ইতোমধ্যে অভিযান চালানো হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা শুরু হবে।

 

নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. এ এফ এম মুশিউর রহমান বলেন, ড্রাগ লাইসেন্স অথরিটি আমি। বিষয়টা আমরা দেখছি। শুনেছি মুদি দোকানেও ওষুধ বিক্রি হয়। আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। সর্বাত্মক চেষ্টা রয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version