মুসলিম ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শনের নাম ‘চিনি মসজিদ’। রঙিন চকচকে চিনা মাটির টুকরো দিয়ে মোড়ানো প্রাচীন ও ঐতিহাসিক এই স্থাপনার অবস্থান নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের ইসলামবাগ এলাকায়। সৈয়দপুর-নীলফামারী সড়কের সাথেই আপন সৌন্দর্যে চিরভাস্বর হয়ে রয়েছে দেড়শত বছর ধরে। এর দৃষ্টিকাড়া ব্যতিক্রমী কারুকার্য মূহুর্তেই মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। ৪৮টি মিনার ও ৪টি গম্বুজ নিয়ে স্থাপিত মসজিদটি ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে বর্ধিত হয়েছে। মূল অংশটি মধ্যভাগে অবস্থিত।
জানা যায়, ১৮৬৩ সালে হাজী বাকের আলী ও হাজী মুকু নামের দু’জন ধর্মপ্রাণ বাসিন্দা ছন ও বাঁশ দিয়ে প্রথমে মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সহায়তায় তা টিনের ঘরে রূপান্তরিত হয়। পরে এলাকার লোকেরা মসজিদটি নির্মাণের লক্ষে তাদের মাসিক আয়ের একটি অংশ দান করে ফান্ড গঠন করেন। এরপর শুরু হয় মসজিদের নির্মাণ কাজ। শঙ্কু নামের জনৈক হিন্দু রাজমিস্ত্রী দৈনিক ১০ আনা মজুরিতে মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করে।
মসজিদের সৌন্দর্য বাড়াতে মসজিদের দেয়ালে চিনামাটির থালা, কাপ ও পিরিচের ভগ্নাংশ ও কাঁচের ভগ্নাংশ বসানো হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘চিনি করা’ বা ‘চিনি দানার কাজ করা’। এখান থেকেই মসজিদের নাম হয়- চিনি মসজিদ বা চীনা মসজিদ। সৌন্দর্যের কাজে ব্যবহৃত চিনামাটির উপকরণসমূহ আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে। ঐতিহাসিক এই মসজিদের নকশা করেন মো. মোখতুল ও নবী বক্স। মসজিদে একসঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক নামাজ আদায় করতে পারেন।
মসজিদটির প্রতিষ্ঠা কালীন সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন হাজী বকর আলী ও পরবর্তীতে তার ছেলে হাজী হাফেজ আব্দুল করিম। প্রথম ইমামের নাম মৌলভী আব্দুল্লাহ আর মুয়াজ্জিন জুম্মন মিয়া। বর্তমান পরিচালনা কমিটির সভাপতি সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিটলার চৌধুরী ভলু। ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাফেজ মাওলানা সাঈদ রেজা, মুয়াজ্জিন হিসেবে রয়েছেন হাফেজ আরিফ রেজা ও খাদেমগিরি করছেন মুহাম্মদ এরশাদ।
পরিচালনা কমিটির প্রধান উপদেষ্টা মো. আবুল কাশেম বলেন, আমার দাদার আমলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। সেসময় অত্র এলাকায় মাত্র একটি মসজিদ ছিল। বড় মসজিদ নামের ওই মসজিদ আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দা হাজী নকর আলী ও হাজী মোখদু কিছু লোকজনের সাথে আলোচনা করে সবাই সম্মত হওয়ায় এই মসজিদ তৈরির উদ্যোগ নেন।
দুই হাজী মিলে মহল্লাবাসীকে ডেকে তাদের মধ্য থেকে কয়েক জনকে সর্দার নির্বাচন করলেন। প্রত্যেকের অধীনে ৪০ জন করে লোক দেওয়া হল। এই সরদারগণ প্রতি ঘর থেকে দৈনিক এক মুঠো করে চাল সংগ্রহ করতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার এই চাল বিক্রি করে টাকায় পরিণত করা হত। এভাবে কিছু টাকা জমা হল। মহল্লাবাসীর সিদ্ধান্তে মসজিদের দালান তৈরি করা হল। মসজিদের উন্নয়নের স্বার্থে এলাকাবাসী স্বেচ্ছায় তাদের ১ মাসের পুরো বেতন দান করেছিলেন। উল্লেখ্য তখন মাসিক বেতন ছিল ১৩-১৫ টাকা। মসজিদ প্রতি বছর চুন করা হত।
মসজিদ কমিটির সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, মসজিদটি নির্মাণ করেন শঙ্খ নামের এক হিন্দু মিস্ত্রী। তাঁর পারিশ্রমিক ছিল দিন প্রতি ১০ আনা। এর বুনিয়াদ প্রথমে ৩০", তারপর ২০" ও উপরে ১৫"।
মসজিদটি তৈরি করতে কোন সহকারি মিস্ত্রীর প্রয়োজন পড়েনি। মহল্লাবাসী নিজেরাই এ কাজ সম্পাদন করেন। সে সময় কোন সিমেন্ট ছিলনা। তাই সুরকি ও চুন দিয়ে গাঁথুনি দেওয়া হয়। মহল্লার মহিলাগণ ঢেঁকি কুটে সুরকি তৈরি করতেন। মহল্লার কিছু লোক কোলকাতা বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁরা সেখানে দেখলেন চীনা কোম্পানির চিনামাটির তৈরি প্লেটের টুকরা পড়ে আছে। কোম্পানির অনুমতি সাপেক্ষে তারা সেগুলো নিয়ে আসেন। শঙ্খ মিস্ত্রী এবং মহল্লাবাসী মিলে সিমেন্ট দিয়ে সেগুলো মসজিদের দেওয়ালে লাগালেন। এই মসজিদের নকশাকারী ছিলেন মো. মখতুল এবং নবী বখ্স।
পুরো মসজিদটির নির্মাণ কাজ ৩ ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশ (মধ্য স্থানে) বৃটিশ আমলে নির্মিত। দ্বিতীয় অংশ (উত্তর পার্শ্বে) পাকিস্তান আমলে এবং তৃতীয় অংশ (দক্ষিণ পার্শ্বে) স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আমলে নির্মিত। প্রথম ভাগটির মেঝেতে মর্মর পাথর বিছানো আছে। মসজিদের ডানদিকে বিছানো এই মর্মর পাথরটি এলাকাবাসী কোলকাতা থেকে প্রতি টুকরা ৬ আনা করে কিনে এনেছিলেন। কোলকাতার কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এখানে এসে পাথরগুলো বসিয়ে যান। বৃটিশ আমলে তৈরিকৃত অংশটুকুর মোট নির্মাণ ব্যয় ছিল ৯৯৯৯ রূপিয়া ১০ আনা।
দ্বিতীয়ভাগটির মেঝেতে এ ধরনের কোন পাথর নেই। এ ভাগের তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এলাকার তৎকালীন সদর ও সেক্রেটারী মো. ওসমান, মো. সফি সুফি, মো. ইয়াজদানি, মো. মফিজ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। মসজিদটি তৈরি করতে আরও যে ব্যক্তির অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন, হাজী বকর আলীর ছেলে হাজী হাফেজ আব্দুল করিম। তিনিই সর্বপ্রথম গোলাহাট রেললাইনের দু'পাশে কবরস্থানের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে মাস্টার ইসরাফিলের ভাই ও আব্দুল গফুরের ছেলে হাফেজ ইদ্রিস এই এলাকার নামকরণ করেন ইসলামবাগ।
মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ আরিফ রেজা বলেন, মসজিদের পশ্চিম দিকে একটা বাড়ি ছিল। বাড়ির মালিক মো. গাউসিয়া জায়গাটি দিতে অস্বীকার করেন। তাছাড়া সে সময় বৃটিশ সরকার সেখানকার সব বাড়ি সরিয়ে পূর্ব দিকে নিয়ে আসে। সে জায়গায় বৃটিশ সরকার খ্রীস্টানদের কবরস্থান বানায়। যা আজও বিদ্যমান। একারণে মসজিদের পিছনে কোন জায়গা নেই। আর সামনে মসজিদ ঘেঁষে রাস্তা। তাই মূল মসজিদের দুই পাশে বর্ধিত করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় তলা নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিশেষ দিনে মুসল্লীদের জায়গা সংকুলান হয়না। তবে দক্ষিণ পার্শ্বে আরও জায়গা আছে। সরকারী সহায়তা পেলে ওইখানে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ করা গেলে এই সমস্যা দূর হবে।
খাদেম মো. এরশাদ বলেন, প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ মসজিদটি দেখতে আসেন। দূর দূরান্ত থেকে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যেও অনেকে আসেন। বিশেষ করে শুক্রবার ও অন্যান্য বিশেষ দিনে বহিরাগত মুসল্লী ও লোকজনের সমাগম ঘটে বেশি। সবাই মসজিদ দেখে মুগ্ধ হয়ে নির্মাণে তৎকালীন ব্যক্তিদের প্রচেষ্টা ও সৌন্দর্য প্রিয়তার প্রশংসা করেন। মূল অংশের নকশার সাথে মিল রেখে নতুন বর্ধিত উত্তর ও দক্ষিণাংশের কারুকাজ করায় দৃষ্টি নন্দন হয়েছে। যে কারণে নতুন কেউ আসলে সহজে বুঝতে পারেন না যে পুরো মসজিদ পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে বর্ণনা দেয়ার পর তারা জানতে পারেন।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য