ভোমরা স্থলবন্দরে ঘাটে ঘাটে পণ্যবাহী ভারতীয় ট্রাকে অবাধে চলছে চাঁদবাজি। চাঁদাবাজির কবলে পড়ে বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। চাঁদার বড় অংকের টাকা ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে। অসহায় হয়ে পড়েছে বন্দরের ব্যবসায়ী, আমদানি-রপ্তানিকারক ও শ্রমিকরা।
দেশের অন্যতম আমদানি-রপ্তানি কেন্দ্র্র সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরটি অন্যান্য বন্দর থেকে ভারতের সাথে যোগাযোগ সহজ এবং কলকাতার সাথে দূরত্ব কম হওয়ায় এই বন্দর দিয়ে ব্যবসায়ীরা আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসা করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু বর্তমানে বন্দরের এই দুরোবস্থার কারণে ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
এদিকে, ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাক থেকে ইচ্ছামত চাঁদাবাজি করছে ভোমরা স্থলবন্দর সিএন্ডএফ কর্তৃপক্ষ। এতে সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে টাকার ভাগ নিচ্ছে জেলার প্রভাবশালী দু’একজন রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কেউ কেউ।
সিএন্ডএফের অসৎ কর্মকর্তারা পকেটে ভরছে দৈনিক ৪০ হাজার রুপি। এর ফলে ভোমরা বন্দর ছেড়ে চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। বন্দরের জিরো পয়েন্টে নির্মিত গোল ঘরে আমদানিকৃত ভারতীয় পণ্যবাহী প্রতিটি ট্রাক থেকে ২০০ রুপি আদায় করছে সিএন্ডএফ এসোসিয়েশন। সেখানে সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনের প্রায় অন্তত ১০ জন কর্মচারী সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে। চাঁদার টাকা নেওয়া হয় ভারতীয় রুপিতে। যা আইনগত বৈধ নয়। কারণ প্রতিদিন তোলা দৈনিক চাঁদার নগদ ভারতীয় রুপি সিএন্ডএফ’র কোষাধ্যক্ষ আবু মুছা ও সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খানের কাছে থাকে।
এই চাঁদাবাজি থেকে পরিত্রাণ পেতে ভোমরা সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনের নামে জিরো পয়েন্টে চাঁদাবাজিসহ নানাবিধ ইস্যু নিয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে পৃথক আলোচনা করেছেন এবং স্মারকলিপি দিয়েছেন ভোমরা স্থলবন্দর আমদানি ও রপ্তানিকারক এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ। এবং তারা স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে অভিযোগ করেছেন। এই চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে গত (২০২৩ সাল) বছরের ২১ জুন থেকে।
এদিকে, ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা বন্ধ করতে ভোমরা স্থলবন্দর এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিম, ব্যবসায়ী অহিদুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম, আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্ট সদস্য রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী, পানি ডাক্তারসহ কয়েকজন সিএন্ডএফ এসোসিয়েশন সদস্য ও আমদানি-রপ্তানিকারক জিরো পয়েন্টে অবস্থান করে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। সিএন্ডএফ এই সময় চাঁদা তোলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু একদিন পরেই কোন এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায় আবারও চাঁদা তোলা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে মাকসুদ খান ও তার সহযোগিরা।
বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও আমদানি-রপ্তানিকারকরা অভিযোগ করে বলছেন, ভোমরা স্থলবন্দর সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খান মোটা অংকের টাকা দিয়ে সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই বন্দরটিকে অস্থিতিশীল করে বন্দরটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন।
ভোমরা বন্দরের ব্যবসায়ী অহিদুল ইসলাম জানান, সিএন্ডএফ’র কর্তৃত্ব এখন আর ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। বন্দরের যারা চিহ্নিত সুদি কারবারি ও হুন্ডি ব্যবসায়ীরাই এখন বন্দররের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। যে কারণে ব্যবসায়ীরা বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বন্দরটি ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা, যারা বন্দরের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখানে ব্যবসা করছেন।
ভোমরা স্থলবন্দর আমদানি ও রপ্তানিকারক এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী বলেন, জিরো পয়েন্টে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা বন্ধ করতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমাদের সবরকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ। ট্রাক প্রতি ২০০ ভারতীয় রুপি চাঁদা তোলায় ব্যবসায়ীদের আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি মাসে ভারতীয় ট্রাক থেকে ১৮-২০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে সিএন্ডএফ। কিন্তু এই টাকার কোনো হিসাব কোনোদিন হয়নি। এই চাঁদার টাকা কে কোথায় ভাগবাটোয়ারা করে, কারা এই টাকার ভাগ পায়, কেউ জানতে পারে না। বন্দরের নীতিমালায়, সিএন্ডএফ’র নীতিমালায় বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো নীতিমালায় ভোমরা স্থলবন্দরের জিরো পয়েন্টে আমদানিকৃত ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক থেকে কোনো খরচ বাবদ চাঁদা নেওয়ার কোনো বৈধতা নেই। আর সিএন্ডএফ’র বর্তমান কমিটি এই টাকার কোনো হিসাব কোনো সভায় উত্থাপন করে না। এই টাকা কে কীভাবে খরচ করে তার কোনো হদিস নেই। চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি।
ভোমরা স্থলবন্দর সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খান বলেন, আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। জিরো পয়েন্টে পণ্যবাহী ভারতীয় ট্রাক থেকে যে ২০০ রুপি চাঁদা তোলা হয় সেই টাকা দিয়ে বন্দরের কিছু কাজ করা হয়। এছাড়া লাইনম্যান হিসেবে কয়েকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বেতনভাতা এই টাকা থেকে দেওয়া হয়। এছাড়া সিএন্ডএফ’র অন্যান্য ব্যয় এই টাকা থেকে হয়। তবে, মাকসুদ খান এই টাকা তোলার আইনগত বৈধতার বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি। তিনি বলেন, এই চাঁদার টাকা দিয়ে বিভিন্ন খরচ মেটাতে হয়।
ভোমরা স্থলবন্দর সিএন্ডএফ এসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক শেখ এজাজ আহমেদ স্বপন বলেন, আমি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে মাত্র কয়েক দিন দায়িত্ব পেয়েছি। এই বিষয়ে আমি সম্পৃক্ত নই। জিরো পয়েন্টে চাঁদাবাজির বিষয়ে আমি তেমন কিছু জানি না। এভাবে চাঁদাবাজির পক্ষে আমার সমর্থন নেই।
ভোমরা স্থলবন্দর কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার এনামুল হক বলেন, বন্দরের জিরো পয়েন্টে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক থেকে ২০০ রুপি চাঁদাবাজির বিষয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। কাস্টমস এই বিষয়ে কিছু করতে পারে না। বন্দরে কাস্টমসের কাজ শুধুমাত্র আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়ন করা। চাঁদাবাজির বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই।
ভোরের আকাশ/মিস
মন্তব্য