-->

হাওরের বাঁধে মাটির পরিবর্তে বালি

লুটপাটের মহোৎসব

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
হাওরের বাঁধে মাটির পরিবর্তে বালি
ক্যাপশন: বালি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করায় ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে

নির্ধারিত সময়ের পর আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়ে দিলেও সুনামগঞ্জের শাল্লা, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার ও জগন্নাথপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি হাওরে বাঁধের কাজ শেষ না হওয়াতে এবারও জেলার এসব উপজেলায় আগাম বন্যার ভয়ে শংঙ্কিত জেলার কয়েক লাখ কৃষক। দেরীতে কাজ শুরু হওয়ায় আগাম বন্যার আগেই বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হবে কিনা তা নিয়েও তাদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।

 

সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে জেলার ১২টি উপজেলার ৯৫টি হাওরের মধ্যে ৪০টি হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে তা চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারী শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড আরো এক সপ্তাহ সময় বাড়িয়ে দেয়ার পরও এসব উপজেলার কয়েকটি হাওরে এখনো বাঁধের কাজ পুরোপুরি শেষ করা হয়নি। অনেক বাঁধে মাটির পরিবর্তে বালি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ; এমনকি ক্লোজার পর্যন্ত বালি দিয়ে করা হচ্ছে। বাঁধের গোড়া থেকে মাটি নিয়ে বাঁধের কাজ করার ফলে ওই সকল বাঁধগুলো এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ থেকে যায়।

 

চলতি বছর সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরে এবার ও আড়াই লাখ বোরো জমি আবাদ করা হয়েছে। অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢল থেকে বোরো ফসল রক্ষায় জেলার ১২টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কারিগরি সহযোগিতায় চলছে বাঁধ নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও হাওরে ক্লোজার নির্মাণ। প্রতিবছরের মতো এবারও কাবিটা নীতিমালার আওতায় জেলার সবকটি হাওরে ৭৩৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ৫৯১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য ১২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।

 

কিন্তু প্রকৃত কৃষকদেরকে পিআইসি কমিটিতে অর্ন্তভূক্ত না করা, কিছু কিছু বাঁধে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর বাঁধের কাজ শুরু করার কথা থাকলেও হাওরের পানি নামতে দেরী হওয়াতে বাঁধের কাজ বিলম্বে শুরু হয়। চলতি মাসের ২৮ ফেব্রুয়ারীতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা থাকার পরও কাজ শেষ না হওয়াতে আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়ে চলতি ৭ মার্চের মধ্যে সকল বাঁধের শতভাগ কাজ শেষ করার কথা ছিল।

 

‘সুনামগঞ্জ জেলা হাওর বাচাঁও’ আন্দোলনের নেতাদের দাবী এখন পর্যন্ত শতকরা ৭৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড দাবী করছে ইতিমধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশী জমির পরিমান শাল্লা, তাহিরপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলায়। শাল্লা উপজেলায় এখানে বাঁধের প্রাক্কলন ও ডিজাইন অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ পুনঃনির্মাণ, ক্লোজারসহ নতুন বাঁধ নির্মাণ বাবত ১২৮টি প্রকল্পের মাধ্যমে এই হাওরে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং অধিকাংশ বাঁধে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে সাধারণ কৃষকদের অভিযোগ।

 

শাল্লা উপজেলার হাওরের ২৩ নম্বর পিআইসি, ২৪ নম্বর পিআইসিতে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়ায় বাঁধের কাজে নয়ছয় হয়েছে। তারা তাদের মূল বাঁধের অর্ধেকেরও বেশী রাস্তায় মাটি না ফেলেই নিয়মিত বিল উত্তোলন করে নিচ্ছেন। এছাড়াও শাল্লার ১নং, ৬নং পিআইসি, ৭নং পিআইসি, ৮নং, ৯নং, ৩৬নং পিআইসি, ১৭নং, ২৫নং, ৫১নং, ৮৯নং, ৯৪নং, ৯৫নং, ৯৭নং, ৯৮নং, ৯৯নং এ সকল পিআইসিতে অপ্রয়োজনীয় অধিক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অনেক বাঁধ ও ক্লোজার বালি মাটি দিয়ে তৈরী করার চেষ্টা চললে ও পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা প্রশাসনের তেমন একটা নেই তদারকি। এদিকে তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওরে পিআইসি নং ৫০, ৫১, ৫২, ৪৯, ৪৮ ও ১৪নং পিআইসিতে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ, বালি দিয়ে বাঁধ ও ক্লোজার নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয় কৃষকদের।

 

এদিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী মার্চের প্রথমদিকে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় উজানের ঢলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির আশঙ্কায় কৃষকরা দুচিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে সকল বাধেঁর কাজ শতভাগ সম্পন্ন করতে জেলা প্রশাসন ও সরকারের নিকট জোর দাবী কৃষকদের। তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওরে ও একই অবস্থা। পিআইসির সদস্যরা স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মণির মিয়ার সাথে যোগসাজসে করা হয় কিছু কিছু বাঁধের অপ্রয়োজনী বরাদ্দ এবং সব মিলিয়ে চলছে ভাগবাটোয়ারার মহোৎসব। ফলে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দের কারণে সরকারের টাকা অপচয় হলেও এসব টাকা অনিয়মের মাধ্যমে পকেটস্থ হচ্ছে কিছু দুর্নীতিবাজ পিআইসি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও দের। অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দের বিষয়টি একাধিকবার প্রশাসনের উচ্চ মহলে জানানোর পরও কোন সঠিক তদন্ত হয়নি।

 

হেমন্ত মৌসুম আসলেই জেলার কোন কোন হাওরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের বাঁধের কাজকে ইস্যু করে চলে লুটপাট। এ ব্যাপারে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, আজ পর্যন্ত গড়ে পুরো জেলায় ৭৫ ভাগ বাঁধের কাজ সম্পন্ন হয়নি। তাছাড়া যে সকল বাঁধে সংস্কারের কথা সেখানে অধিক পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া মানে লুটপাটেরই অংশ। এখনো অধিকাংশ বাঁধে ধুমূজ, ঘাস লাগানো ক্লোপ দেয়া হয়নি। এবারের হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ ও অপ্রয়োজনীয় বেশী বেশী বরাদ্দ যে দেয়া হয়েছে তা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশী এবং বাঁধের কাজ ও অনেক খারাপ বলে তিনি দাবী করেন। জেলার শাল্লা, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার ও জগন্নাথপুরের যেসব হাওরে মাটির পরিবর্তে বালি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তা অতি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ। আর দুয়েকদিন পর যখন বৃষ্টিপাত শুরু হবে এবং উজান থেকে নেমে আসবে পাহাড়ি ঢল তখন ওইসব বাঁধে প্রথম আঘাত করবে। ফলে ওইসব হাওরে কৃষকদের ফসল রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ কেন দেওয়া হলো এবং এই লুটপাঠের সাথে কারা কারা জড়িত তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানান তিনি।

 

এ ব্যাপারে তাহিরপুরের দায়িত্বে থানা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ সহকারী প্রকৌশলী মো. মণির হোসেন সাথে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে ও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

 

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, আজ পর্যন্ত পুরো জেলায় বাধেঁর কাজ ৯৮ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। তবে হাওর বাচাঁও আন্দোলনের এক নেতার বক্তব্য অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ এবং লুটপাটের বিষয়টিকে তিনি অস্বীকার করে জানান উনাদের কাছে এমন তথ্য প্রমাণ থাকলে আমাদের নিকট উপস্থাপন করলে তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version