-->
শিরোনাম

তরমুজে সয়লাব বরিশালের বাজার

এস এল টি তুহিন, বরিশাল
তরমুজে সয়লাব বরিশালের বাজার
বিক্রি উদ্দেশ্যে ট্রলার থেকে তরমুজ নামানো হচ্ছে

পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে মৌসুম শুরুর আগেই বরিশালের বাজার রসালো ফল তরমুজে সয়লাব হয়ে গেছে। তবে বাড়তি মুনাফা নিতে অপরিপক্ক তরমুজই বিক্রি হচ্ছে বেশি। তরমুজের দাম নিয়েও চলছে টালবাহানা। খেত থেকে পাইকাররা ঠিকা কিনলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে।

 

কৃষক আগেভাগে তরমুজের চাষাবাদ করে বাড়তি দামের আশা করছে। আর পাইকাররা তাদের কাছ থেকে স্বল্প মূল্যে তরমুজ খেত থেকে ক্রয় করে তার সুফল ভোগ করছেন।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর চৈত্রের মাঝারী বর্ষণে তরমুজ চাষীদের কপাল পোড়ায় এবার বরিশাল কৃষি অঞ্চলে আবাদ প্রায় ৩০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। গত বছর ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হলেও এবার ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। ফলে উৎপাদনও গত বছরের ২৭ লাখ টন থেকে এবার ২০ লাখ টনে নেমে আসার শঙ্কা করেছেন কৃষিবিদরা।

 

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার কৃষক ইমরান হোসেন এবার প্রায় ১৩০ একর জমিতে আগাম তরমুজ আবাদ করেছেন। ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। ১০ রমজান থেকে তিনি তার খেতের তরমুজ বাজারজাত করবেন। এতে লাভবান হওয়ার আশা করছেন ইমরান।

 

পটুয়াখালীর বাউফল থেকে ট্রলারযোগে গত ২০ মার্চ সকালে ১৭শ’টি তরমুজ নিয়ে বরিশাল নগরীর ফলের আড়তে এসেছেন কৃষক খোকন হাওলাদার। ১৬০ টাকা প্রতিটি করে ১০০ পিস তরমুজের দর উঠেছে ১৬ হাজার টাকা। তার চাহিদা ছিলো ২০ হাজার টাকা। খোকন বলেন, চাহিদা অনুযায়ী আড়ৎদার দাম না বলায় আমি চরম হতাশ। কারণ সার, ওষুধ ও শ্রমিকের খরচ মিটিয়ে ভালো দাম না পাওয়ায় লোকসানের মুখে পরতে হবে।

 

বরিশাল নগরীর পোর্ট রোড হাওলাদার ফল ভান্ডারের স্বত্বাধীকারি মনির হোসেন হাওলাদার বুধবার দুপুরে বলেন, এবছর সব কিছুর দাম বেশি। তাই তরমুজেরও দাম বেড়েছে। চৈত্রের শেষদিকে তরমুজের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

নগরীর চৌমাথা বাজার এলাকার ফলের দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ঠিকা এবং কেজি দরে। নগরীর সব জায়গাতেই মৌসুমী রসালো ফল তরমুজ একইভাবে বিক্রি হচ্ছে। যা কিনে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না সাধারণ ক্রেতারা।

 

তরমুজ ক্রয় করতে আসা বরিশালের একটি বেসরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক রমজান আলী বলেন, একটি মাঝারি তরমুজ ক্রয় করে হলে ৪ থেকে ৫শ’ টাকা লাগে। আমার বাবা-দাদারাও কোনোদিন কেজিতে তরমুজ কিনে খায়নি। আমাকে কিনতে হচ্ছে। তাই সাধ থাকলেও সাধ্য না থাকায় মৌসুমী ফল খেতে আগ্রহ হারাতে হচ্ছে।

 

আরেক ক্রেতা গৃহিনী মমতাজ বেগম বলেন, ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আসার আগে আমি ৮০ টাকা কেজি দরে তরমুজ ক্রয় করেছি। তখন কেজি দরে তরমুজ বিক্রিতে আপত্তি জানালে ব্যবসায়ীরা আমার কাছে তরমুজ বিক্রি করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। কিন্তু যখন ম্যাজিষ্ট্রেট আসে তখন তরমুজ মাপার মিটারের দাড়িপাল্লা লুকিয়ে রেখে পিস হিসেবে তরমুজ বিক্রি করা হয়। ম্যাজিষ্ট্রেট চলে গেলে আবার সেই আগের অবস্থায় কেজি দরে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

 

জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম বলেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিংবা ফলের দাম বেশি রাখা হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি বাজার নজরদারির অংশহিসেবে প্রতিদিনই ভ্রাম্যমাণ আদালত অসাধু ব্যবসায়ীদের জরিমানা এবং সতর্ক করা হয়েছে ।

 

সূত্রে জানা গেছে, উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা মহাদেশ ছাড়িয়ে সুমিষ্ট রসালো ফল তরমুজ বাংলাদেশের নদীবহুল বরিশাল অঞ্চলে ইতোমধ্যে অর্থকরী ফসলের তালিকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরী করেছে। সারাবিশ্বসহ দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই তরমুজের আবাদ হলেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এর আবাদ ও উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। যার সিংহভাগ অর্জনই বরিশালের কৃষি যোদ্ধাদের। বেলে দো-আঁশ থেকে এটেল দো-আঁশ পর্যন্ত সবধরনের মাটিতে তরমুজের চাষ হচ্ছে। এমনকি নদ-নদীবহুল বরিশলের নোনা পানিমুক্ত চরাঞ্চলের পলি মাটিতে তরমুজের ভাল ফলন হচ্ছে।

 

কিন্তু সাম্প্রতিককালে অকাল বর্ষণ ও অব্যাহত অনাবৃষ্টিসহ আবহাওয়ার খেয়ালী আচরণ বিরুপ পরিস্থিতি তৈরী করছে। গতবছর টানা প্রায় পাঁচ মাস পরে মার্চের মধ্যভাগ থেকে কয়েক দফা হালকা থেকে মাঝারী ও ভারি বর্ষণে জমিতে পানি জমে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয় তরমুজ খেত। অনেক এলাকার চাষীরা মাঠ থেকে তরমুজ উত্তোলনই করতে পারেননি।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, এবছর রাঙ্গাবালীসহ সংলগ্ন এলাকায় তরমুজ বাগানে একধরনের মড়ক লেগেছে। এতে করে গাছের ডগার রঙ বিবর্ণ হয়ে কখনো পচন শুরু হয়। সাথে ফলের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়ে অকালে ঝড়ে যাচ্ছে।

 

একই জমিতে অব্যাহত তরমুজ আবাদের ফলে এ ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে। প্রতি তিন বছর অন্তর ফসল পরিবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করে মাঠপর্যায়ের কৃষিকর্মী বা ব্লক সুপারভাইজাররা নিবিড় পর্যবেক্ষন ও সুপারিশ করলেও চাষীরা কর্ণপাত না করার কারণেই ফসল বিপর্যয় হচ্ছে।

 

তবে বরিশালসহ সারাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩৫-৪০ লাখ টন তরমুজ উৎপাদন হলেও তা প্রক্রিয়াজাত করে কোনধরনের খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুতের উদ্যোগ নেই। বরিশালে দীর্ঘদিন থেকে একটি ‘কৃষি ও মৎস্য ভিত্তিক রফতানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা’ প্রতিষ্ঠার দাবী সাধারণ মানুষের। তরমুজসহ অন্যান্য ফল এবং ফসলকে কেন্দ্র করে একটি রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা প্রতিষ্ঠিত হলে তা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশাবাদী অর্থনীতিবীদরা।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version