‘সিডরের পর এই জাগায় কোনো ফসল অইতো না। ক্যামনে অইবে? খালি নুন আর নুন। তিন বছর আগে বাঁধ অওনে এহন একটা ফসল অয়, আমন ধান। হ্যারপর জমি খালি থাকে। এইবার আমন পাকনের আগে গমের বীজ ছিটাইয়্যা চাষ করছি। সবাই কইছেলে এইয়্যা অইবে না। এহন দ্যাখেন খ্যাতে গম আর গম।’
উপকূলের লবণাক্ত জমিতে ‘বিনা চাষে’ গম চাষ করা বরগুনার তালতলী উপজেলার শারিকখালী ইউনিয়নের নলবুনিয়া গ্রামের কৃষক ইদ্রিস হাওলাদার এসব কথা বলছিলেন। গত নভেম্বরে তিনি যখন খেতে আমন থাকতে গমের বীজ ছিটান, তখন এলাকার অনেকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছিলেন। এখন সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে খেত ফসলে ভরে গেছে।
শুধু ইদ্রিস নন, নলবুনিয়া গ্রামের ২০ জন কৃষক এবার প্রথমবারের মতো সাত একর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে বিনা চাষে গম আবাদ করেছিলেন। সফলও হয়েছেন। প্রতি বিঘা (২০ শতাংশ) জমিতে ১০ মণ করে গম উৎপাদিত হবে বলে আশা। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গমের গাছ। গাছের শাখায় শাখায় দোল খাচ্ছে পরিপুষ্ট গমের ছড়া। কয়েকজন গম কাটা শুরুও করে দিয়েছেন।
কৃষি বিভাগ জানায়, অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ (এসিআইএআর) এর সহায়তায় ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এবং পভার্টি ইরাডিকেশন প্রকল্পের আওতায় সাত বছর ধরে মাঠপর্যায়ে গবেষণার পর লবণাক্ত জমিতে বিনা চাষে গম আবাদের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। এই প্রযুক্তির নাম রিলে। প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং এসিআইএআর-যৌথভাবে গমের জাত এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পাঁচ বছর ধরে কাজ করছে।
জমিতে ধান থাকা অবস্থায় সেই খেতে গমবীজ ছিটিয়ে ফসল চাষাবাদকে রিলে পদ্ধতিতে গম চাষ বলা হয়ে থাকে। উপকূলের পতিত নোনা জমিতে আমন ধান কাটার ২০-২৫ দিন আগেই কৃষকেরা ধানের জমিতে গমের বীজ ছিটিয়ে দেন। এটা করা হয় নভেম্বরের মাঝামাঝি। কৃষি গবেষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ওই সময় জমির মাটি কিছুটা ভেজা ভেজা থাকে। এ সময় জমিতে লবণাক্ততাও অনেক কম থাকে।
গমের বীজ ছিটানোর তিন-চার দিনের মধ্যেই এর থেকে চারা গজাতে শুরু করে। গমগাছের বৃদ্ধিকালে ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচের তাপমাত্রায় গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে। সে কারণে মধ্য নভেম্বরে জমিতে গমবীজ বপন করলে জানুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে গমগাছ তার বৃদ্ধির সময়ে কাঙ্খিত তাপমাত্রা পায়, ওই সময়ে ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং ভালো ফলন দিতে সক্ষম।
কৃষকেরা বলেন, রিলে পদ্ধতিতে এক বিঘা জমিতে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা খরচ করে ৪০০ কেজি (১০ মণ) গম পাওয়া যাবে। যার মূল্য প্রতি কেজি ৫০ টাকা হিসেবে ২০ হাজার টাকা। উপকূলের পতিত জমিতে রিলে পদ্ধতিতে গম ফসল চাষাবাদ ছড়িয়ে দিতে পারলে ৪ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর পতিত জমিতে ১৩ লাখ টন বা ৩ কোটি মণ গম উৎপাদন করা সম্ভব।
এলাকার কৃষক আবুল কাশেম বলেন, গত বছরের ১৯ নভেম্বর গম আবাদের পর ১০ ডিসেম্বর সার দেন। ২০ ডিসেম্বর প্রথম হালকা সেচ দিই। এরপর আরও দুবার সেচ দিয়েছেন। ভালো ফলন হয়েছে। উপকূল অঞ্চলে শুধু বৃষ্টির মৌসুমে বছরে একটি মাত্র ফসল, আমন ধান হয়। এই ধান কৃষকেরা ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কেটে ঘরে তোলেন। এরপর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অপঘাতে শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় এবং সেচযোগ্য পানির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৪ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সাত মাস কোনো ফসল ফলানো সম্ভব হয় না।
এই বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলের লবণাক্ত পতিত জমিতে ফসল ফলানোর লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চের সহায়তায় ২০১৭ সাল থেকে এসব জমিতে বাড়তি ফসল উৎপাদন করা যায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন একদল গবেষক। গমজাতীয় ফসলে অল্প পানি সেচ দিয়েই ভালো ফসল উৎপাদন সম্ভব এবং ফসল হিসেবে গম প্রকৃতিগতভাবেই কিছুটা লবণসহিষ্ণু। তাই রিলে পদ্ধতিতে গম ও মুগ ফসলের প্রযুক্তি উদ্ভাবনে নিবিড় গবেষণায় মনোযোগ দেন গবেষকেরা।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, জমির ১ হাজার ১০০ ফুট থেকে ১ হাজার ২০০ ফুট গভীরের পানি লবণাক্ত নয় এবং তা সেচযোগ্য। আর সাবমার্সিবল পাম্পের সাহায্যে ১ হাজার ১০০ ফুট বা তার নিচের পানি উত্তোলন করা সম্ভব। পাম্পটি কিনতে এবং বসাতে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এ ধরনের একটি পাম্প দিয়ে ২০ থেকে ২৫ বিঘা জমিতে অনায়াসে রিলে প্রযুক্তিতে গমসহ অন্য রবি ফসলের চাষাবাদ করা যায়। ২০২২ পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পূর্ব দৌলতপুর গ্রামের কয়েকজন কৃষককে এ প্রযুক্তির বিষয়ে ধারণা দিয়ে গমের চাষ করানো হয়েছিল। ওই বছর সামান্য জমিতে আবাদ করে সফলতা পাওয়া যায়। সেই সূত্র ধরে তালতলীর শারিকখালীর নলবুনিয়া গ্রামে এবারই প্রথম গমের আবাদ করেছেন কৃষকেরা।
পূর্ব দৌলতপুর গ্রামের গমচাষি আবদুল খালেক জানান, গম আবাদে হাজার পাঁচেক টাকা খরচ হয়েছে। বিক্রি করে অন্তত ১৫ হাজার টাকা লাভ করতে পারবেন। গবেষক দলের নেতা মৃন্ময় গুহ নিয়োগী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় জমির লবণাক্ততা দিন দিন বাড়ছে, ফলে শুষ্ক মৌসুমে প্রচুর জমি পতিত থাকছে। এই প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করা গেলে উপকূল অঞ্চলে কৃষকেরা শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত একটি ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ৪ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর জমি শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততার কারণে পতিত থাকে। এই প্রযুক্তি সম্প্রসারিত করা গেলে বছরে ১৩ লাখ টন গম উৎপাদন করা সম্ভব।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য