-->
শিরোনাম

টুপি তৈরীতে স্বচ্ছল কাউনিয়ার নারীরা

রংপুর ব্যুরো
টুপি তৈরীতে স্বচ্ছল কাউনিয়ার নারীরা
কারুকাজ খচিত টুপি তৈরিতে ব্যস্ত নারীরা

হাতের স্পর্শে তৈরি হচ্ছে কারুকাজ খচিত টুপি। সুই ও সুতা থেকে সরছে না কারও দৃষ্টি। এদিক-সেদিক দেখার সময় নেই তাদের। কেউ ব্যস্ত টুপির ওপর নকশা বুনতে, কেউবা আবার কাপড় কাটতে। রাত-দিন চলছে এমন কর্মযজ্ঞ। যেন দম ফেলার সময় নেই তাদের। দিনের পর দিন এভাবেই একেকটি টুপি রূপ নিচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শিল্পে।

 

রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ও শহীদবাগ ইউনিয়নের সাহাবাজ, থানাপাড়া, সাব্দী ও ভূতছাড়া গ্রামে দেখতে পাওয়া যায় এমন দৃশ্য। এই ইউনিয়নসহ কাউনিয়া উপজেলার কমবেশি প্রতিটি গ্রামে আছেন এমন টুপি তৈরির হাজারো কারিগর।

 

করোনা মহামারির কারণে গেল চার বছর থমকে ছিল টুপি রপ্তানি। খুব বেশি চাহিদা না থাকায় তেমন ব্যস্ততাও ছিল না কারিগরদের। তবে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসাতে আবার বেড়েছে টুপির চাহিদা। রপ্তানিমুখী টুপি ঘিরে তিস্তা নদীবেষ্টিত কাউনিয়া উপজেলার অন্তত ৪০ গ্রামের ৩৫ হাজারের বেশি নারী এখন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে স্বামী-পরিত্যক্তা ও হতদরিদ্র প্রায় ১৩ থেকে ১৫ হাজার নারীর মূল পেশাই এখন টুপির কাজ। সংসারের কাজ সামলে অবসরে টুপিতে নকশা বোনেন নারীরা। এতে বাড়তি আয়ের মুখ দেখছেন তারা। এ কাজ করে পুরুষদের পাশাপাশি গ্রামের নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। বাজারে পাকিস্তানি টুপি শীর্ষস্থান দখল করে থাকলেও রংপুর অঞ্চলের দৃষ্টিনন্দন টুপি দেশের গন্ডি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ ওমান, কুয়েত, কাতার, সৌদি ও বাহরাইনসহ প্রায় ২০টি দেশে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে।

 

সরেজমিনে কাউনিয়ার বালাপাড়া শহীদবাগ ইউনিয়নের শাহবাজ, থানাপাড়া, চর হরিশর, সাব্দি ভূতয়াড়া গ্রামে দেখা গেছে, সাংসারিক কাজ কিংবা রান্নাঘরেও চলছে টুপি তৈরির কাজ। এই টুপি তৈরি করে একসময়ের অভাব-অনটনে থাকা দরিদ্র নারীদের জীবনচিত্রই পাল্টে গেছে। তারা এখন স্বাবলম্বী। তাদের সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেও আগের মতো নেই হতাশার ছাপ।

 

কিন্তু রংপুরে এই শিল্পের শুরুর গল্পটা এমন ছিল না। কাউনিয়ার সাব্দী গ্রামে ২০১৩ সালে টুপির কাজ নিয়ে রুবেল মিয়া। লক্ষীপুর থেকে আসা এ আগন্তুককে তখন গ্রামের অনেকেই জায়গা দিতে রাজি হয়নি। বাড়ির একটি ঘর ছেড়ে দিয়ে টুপি তৈরির শুরুটা দেখতে চেয়েছিলেন ওই বাড়ির বাসিন্দা আবোর উদ্দিন। এখন তিনি বেঁচে নেই। আবোর উদ্দিনের সেই বাসা থেকেই শুরু নারীদের সূক্ষ¥ হাতের সেলাই করা টুপির কাজ। শুরুর দিকে কয়েকজন নারী জড়িত থাকলেও ক্রমাগত তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তারপর মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো শুরু করেন। আরব দেশে এই টুপির চাহিদা বেশি থাকায় পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জহিরকে। বর্তমানে ওমানে তার দুটি টুপির দোকান রয়েছে।

 

কাউনিয়ার শাহবাজ থানা পাড়া গ্রামের টুপির কারিগর নুরনাহার, মাজেদা, হাওয়া বেগম, শেফালী বেগম জানান, একটি টুপির নকশা বুননসহ অন্য কাজ মিলে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ দিন। মাসে গড়ে তারা একেকজন ৩-৪টি করে টুপি তৈরি করেন। প্রতিটি টুপিতে নির্দিষ্ট নকশা ও সাইজ অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। তাদের অনেকে সরকারিভাবে এই শিল্পে প্রনদনা ও সহায়তার প্রয়োজন বলে আশা প্রকাশ করেন।

 

সেখানকার খোর্দ্দ ভুতছড়া গ্রামের টুপি শ্রমিক আমেনা ও আনিছা বেগম জানান, প্রায় ১২ বছর ধরে টুপি তৈরির কাজ করছেন। তাদের একেকজনের এখন মাসিক আয় ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা। তারা টুপির চারদিকে মোটা সুতা ঢোকানোর কাজ করেন, যাকে বলা হয় হাসু। এতে প্রতিটা টুপির জন্য ৫০ থেকে ৮০ টাকা করে পেয়ে থাকেন। রপ্তানিযোগ্য এ শিল্পের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে বালাপাড়া ইউনিয়নের টুপি ব্যাবসায়ি তাউস ট্রেডিং এন্ড গার্মেন্টসের মালিক জাহাঙ্গির আলম বলেন, বেকার ও দুস্থ নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই টুপি শিল্প সচ্ছলতার পথ খুলে দিয়েছে।

 

তিনি অরো বলেন, কর্মী ও এজেন্টদের মাধ্যমে আমরা টুপি তৈরি করে নিচ্ছি। কর্মীদের বাড়ি বাড়ি সুতাসহ টুপি দিয়ে আসি নকশা করার জন্য। প্রতি পিস টুপিতে নকশা করার জন্য তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পেয়ে থাকেন। প্রতি মাসে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টুপি ওমানে পাঠানো হচ্ছে। মান, আকার ও প্রকারভেদে একেকটি টুপি তৈরিতে খরচ পড়ছে ৭০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব টুপি ৬ হাজার টাকা থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। টুপি তৈরির কাজ কওে ইতোমধ্যেই তিনি জেলা পর্যায়ে উদ্দ্যক্তা হিসেবে পুরুস্কার পেয়েছেন।

 

সাহাবাজ গ্রামের টুপির এজেন্ট গোলাম রব্বানী বাবু বলেন, আমার ১৩টি কেন্দ্র থেকে মাসে প্রায় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টুপি তৈরী করে বিক্রি করে থাকি।

 

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version