-->
শিরোনাম

জমজমাট রূপগঞ্জের জামদানি পল্লী

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি
জমজমাট রূপগঞ্জের জামদানি পল্লী
ক্যাপশন: জামদানি পল্লীতে কর্মমুখর সময় কাটছে তাঁতিদের

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার বিসিক শিল্পনগরীর জামদানি পল্লীতে তাঁতিদের যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। সামনে ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখ। সে কারণে তাদের ব্যস্ততাও বেড়েছে বহুগুণ। ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ির ইতিহাস কয়েকশ বছরের। বাঙালি নারীর পরিশীলিত সৌন্দর্যবোধ ও আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকার এই জামদানি শাড়ি। যার আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। এ উপজেলার নোয়াপাড়া বিসিক শিল্পনগরীর জামদানি পল্লীতে কর্মমুখর সময় কাটছে এখন প্রায় ৬ হাজার তাঁতির।

 

গত কয়েক বছরে করোনাসহ বিভিন্ন কারণে খানিকটা মন্দা দেখা দিলেও এবারের ঈদ ও বৈশাখ সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এ শিল্প। অবশ্য এবার জামদানি পল্লীতে সরাসরি যত ক্রেতা আসছেন, তার থেকে বেশি ক্রেতা মিলছে অনলাইনে। ই-কমার্স ও সরাসরি শাড়ি কিনতে আসা ক্রেতাদের সমন্বয়ে ঈদ ও পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে প্রায় শত কোটি টাকার শাড়ি বিক্রি হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও তাঁতিরা।

 

তারা জানাচ্ছেন, সারাদেশ থেকে পাইকাররা এসে নিয়ে যাচ্ছেন রূপগঞ্জের এই শাড়ি। এ ছাড়াও প্রায় ২০ কোটি টাকার জামদানি শাড়ি রপ্তানি হতে চলেছে ভারত, ভুটান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। এর ফলে দেশেও আসছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।

 

ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি বিভিন্ন রকম ডিজাইনের হয়ে থাকে। যার মধ্যে বেশি জনপ্রিয় হলো পান্না হাজার, তেরছা, পানসি, ময়ূরপঙ্খী, বটতপাতা, করলা, জাল, বুটিদার, জলপাড়, দুবলী, ডুরিয়া, বলিহার, কটিহার, কলকাপাড় ইত্যাদি ডিজাইনের জামদানি। শুক্রবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খটখট শব্দে মুখর হয়ে উঠেছে রূপগঞ্জের জামদানি পল্লী। স্পিকারে জোরে জোরে বাজানো হচ্ছে গান। সেই গান শুনতে শুনতে মনের আনন্দে কাজ করছেন তাঁতিরা। দোকানগুলোতে পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের ভিড় ছিল বেশ লক্ষণীয়। জামদানি পল্লীতে ৪০টির মতো এ শাড়ির শোরুম রয়েছে। এসব শোরুম থেকে পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারা নিজেদের পছন্দমতো বিভিন্ন নান্দনিক ডিজাইনের জামদানি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আগে তাঁতিরা শুধু জামদানি শাড়ি তৈরি করলেও বর্তমানে জামদানি দিয়ে পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস, টু-পিস ও বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে জামদানির বাজার আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। অবশ্য ক্রেতারা হতাশা প্রকাশ করলেন জামদানি পল্লীর পরিবেশ নিয়ে। রাস্তাঘাট বেহাল এবং ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে জামদানি পল্লীর সৌন্দর্য অনেকটাই স্নান হয়ে গেছে বলে মনে করছেন এখানে আসা ক্রেতারা।

 

তাঁতিরা জানালেন, এবারের ঈদ ও পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে প্রায় শত কোটি টাকার শাড়ি বিক্রির টার্গেট রয়েছে তাদের। জামদানি পল্লীর তাঁতি ও দোকান মালিকদের সবারই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেজ রয়েছে। ঈদ সামনে রেখে সেই পেজের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত তাঁতি নিজেদের তৈরি করা জামদানি শাড়ি বিক্রি করে চলেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ই-কমার্সে বেশ সাড়াও পাচ্ছেন তারা। তাদের বুনন করা শাড়ি বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে। একেকটি শাড়ি ৫ হাজার থেকে শুরু করে ২ লাখ টাকা দামে বিক্রি হয়ে থাকে। তাঁতিদের কাছ থেকে জামদানি কিনে অনেক উদ্যোক্তাও অনলাইনে বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছেন।

 

জামদানি পল্লীর বিসমিল্লাহ জামদানির মালিক আসিফ জানান, গত কয়েক বছর জামদানির বাজার খারাপ গেলেও এ বন্ধ্যা থেকে চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। বিশেষত ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে তাদের বিক্রিও বেড়েছে বহু গুণ। আগে তিনি শাড়ি বিক্রি করে তাঁতিদের মজুরি দিতে হিমশিম খেলেও বর্তমানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

 

সোহাগ জামদানির মালিক সোহাগ জানান, তার বাবা নজরুল ইসলাম ২০ বছর ধরে জামদানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। জামদানি পল্লীতে তার বাবার দোকানও রয়েছে। তিনি সরকারি মুড়াপাড়া কলেজে অনার্সে লেখাপড়া করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত বছর সোহাগ জামদানি নামে একটি পেজ খোলেন তিনি। কয়েক মাস যেতে না যেতেই দোকানের পাশাপাশি অনলাইনেও তার জামদানি শাড়ি বিক্রি হতে থাকে।

 

রূপগঞ্জের জামদানি পল্লী থেকে জামদানি কিনে অনলাইনে বিক্রি করেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সামিরা আক্তার মিতু। ‘কুসুম ফুল জামদানি’ নামে তার ফেসবুক পেইজ রয়েছে। লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে জামদানি বিক্রি করছেন তিনি। সাড়াও পাচ্ছেন বেশ। তিনি বলেন, আমি একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করছি। এছাড়া, অনলাইনে জামদানি শাড়ির ব্যবসা রয়েছে। ঈদ সামনে রেখে আমার অনলাইনে অনেক ইউনিক ডিজাইনের জামদানির কালেকশন উঠিয়েছি। তবে তাঁত কারিগরদের অভিযোগ, গত কয়েক বছর জামদানির বাজারে মন্দার অজুহাতে তাঁতকল মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি বাড়াননি। কিন্তু এ বছর জামদানির বাজার অনেক ভালো। তারপরও তাঁত কারিগরদের মজুরি তেমন বাড়ানো হয়নি। শাড়ির বিক্রি ও দরদাম বাড়লেও তাঁতকলের মালিকরা তাদের মজুরি বাড়াননি। এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে বর্তমান মজুরিতে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

এ ব্যাপারে তাঁতকল মালিকদের দাবি, জামদানি শাড়ির বিক্রি বাড়লেও খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সুতার দাম, রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খরচ বেড়ে যাওয়ায় শাড়ি বিক্রি বেশি হলেও তেমন একটা লাভ হচ্ছে না। তাই কারিগরদের মজুরিও তেমন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version