নদীটির নাম বারনই। এর প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। বারনইয়ের উৎপত্তি হয়েছে নওগাঁ জেলার আত্রাইয়ের একটি বিল থেকে। তানোর উপজেলার মধ্য দিয়ে শিবনদী নাম ধারণ করে পবা উপজেলার বাগধানী এলাকায় এসে এই নদীটির নাম হয়েছে বারনই। দখল আর সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্যে মৃতপ্রায় অবস্থা রাজশাহীর পবা উপজেলার অর্ন্তবাহিত এই নদীটি। দীর্ঘদিন নদী ড্রেজিং না করার ফলে নদী তার নাব্যতা হারিয়েছে।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য সরাসরি এই নদীতে ফেলায় নদীর ভারসাম্য এখন হুমকির মুখে। নগরীর তরল বর্জ্য বর্তমানে সিটি পশু হাটের পার্শ্বের ড্রেন দিয়ে দুয়ারী খালে এবং রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভবনের পেছনে পবা গাঙ্গপাড়ার গাঙ্গদিয়ে বায়া বাজারের পাশের খালে ফেলা হচ্ছে। যা পরবর্তীতে নওহাটায় বারনই নদীতে গিয়ে পড়ছে।
এই বিষাক্ত পানির মধ্যে রয়েছে শহরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এর বর্জ্য, বিসিকসহ অন্যান্য মিল-কারখানার কেমিক্যাল বর্জ্য, নগরীর পয়ঃনিষ্কাশনের বিষাক্ত বর্জ্য। এসব কেমিক্যাল মিশ্রিত বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থযুক্ত পানি প্রতিনিয়তই পবা উপজেলার কুজকাই খাল, পাকুড়িয়া, দুয়ারী ক্যানেল, বায়া-মহনন্দখালী খাল হয়ে বারানই নদীতে এসে পড়ছে।
নদীপাড়ের অসংখ্য মানুষের ব্যবহার ছিলো এই নদীর পানি। কিন্তু দূষণে আর বিষাক্ততায় এই নদীর পানি ব্যবহার করা যায় না। বর্জ্যের কারণে পানি দূষণে এই নদীতে মাছ বাঁচতে পারে না। তার উপর আবার নদীর কিছু জায়গায় অবৈধভাবে মাছ শিকারের জন্য পানি আটকিয়ে করা হচ্ছে নদী দখল। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। নদীর পাশ্ববর্তী অনেক জায়গায় অবৈধভাবে অনেক স্থাপনা গড়ে দখল করা হচ্ছে। এতে নদী আরো সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহীর পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা, পুঠিয়া উপজেলার এবং নাটোরের ২টি উপজেলার বারনই নদী পাড়ের গ্রামগুলোর মানুষরা নদীতে গোসল করে আক্রান্ত হচ্ছেন ডাইরিয়া, দাদ, চুলকানি, পঁচড়াসহ বিভিন্ন চর্মরোগে। নদীর পানি পান করে গবাদিপশু আক্রান্ত হচ্ছে নানান রোগে। এছাড়া এই বিষাক্ত পানি দিয়ে আবাদ হচ্ছে সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের। সবজিসহ এই ফসলগুলো কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা বিবেচনার সময় এসেছে। জরুরি ভিত্তিতে এই বিষাক্ত তরল বর্জ্যের প্রবাহ রোধে যুতসই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।
বারনই নদীর ময়লা পানির কারণে নওহাটা পৌরসভার নদী পাড়ের যে গ্রামগুলোর মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সে গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে নওহাটার বাবুপাড়া, টিকটিকি পাড়া, হলদারপাড়া, দুয়ারী, পুঠিয়াপাড়া, মধুসুদনপুর, আলাই বিদিরপুর, পিলাপাড়া, বড়গাছির মথুরা, ইটাঘাটি, আমগাছি।
পৌরসভার পুঠিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা আকরাম আলী বলেন, আগে আমরা দেখতাম এই নদী দিয়ে বিভিন্ন বড় বড় নৌকা, ছোট ট্রলার চলাচল করতো। সেই সময়ে আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো এই নদী। এই নদী দিয়ে আমরা ভবানীগঞ্জ, বাগমারা বিভিন্ন পণ্য নিয়ে গেছি। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন এই নদী হারিয়ে যাচ্ছে। নদীটি বাঁচাতে হলে খুব শীঘ্রই নদী ড্রেজিং করে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করতে হবে। নদীর পানি যাতে দূষিত না হয় সেই দিকে সবার লক্ষ্য রাখতে হবে।
পিলাপাড়া এলাকার আয়েশা বেগম এর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমরা গোসল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে এই নদীর পানি ব্যবহার করতাম। কিন্তু এখন এই নদী নদীর পানি থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। এই নদীর পানিতে গোসল করলে গায়ে চুলকানি (ফুসকড়ি) বের হয়। তাই আমরা আর এই নদীর পানিতে গোসল করি না।
মোহনপুর উপজেলার হাফিজ আলী নামের এক নদী তীরবর্তী বাসিন্দার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমাদের এই নদীতে আগে কত মাছ হতো। কিন্তু এখন মাছ তো দূরের কথা আমরা এই নদীতে গোসল পর্যন্ত করতে পারিনা। নদীর পানি থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। কালো এই পানিতে গোসল করলে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা হয়। তাই আমি চাইবো আমাদের এই নদীটিতে যাতে পানি দূষণ না হয়।
এই বিষয়ে পবা উপজেলার সেনেটারী ইন্সপেক্টর জালাল আহম্মেদ বলেন, নগরীর তরল বর্জ্যের কারণে পবার বায়া ও দুয়ারি ২টি খালসহ বারনই নদীর মাছ মরে যাচ্ছে। এই দূষিত পানির কারণে নদীপাড়ের মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছেন ডাইরিয়া-চুলকানিসহ বিভিন্ন অসুখে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি বিষয়টি তার উর্ধ্বোতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন বলে জানান।
হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, রাজশাহী মহানগরীর তরল বর্জ্য পবার যে দুটি খালে ফেলা হচ্ছে সে দুটির মধ্যে বায়া এলাকাটির নাম বারাহী নদী এবং দুয়ারীটির নাম বিলুপ্ত নবগঙ্গা নদী। এই দুটি নদী বেয়ে নগরীর তরল বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নওহাটার বারনই নদীতে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসার উচিত নগরীর তরল বর্জ্য পরিশোধন করে নদী ৩টিতে ফেলা। তা না হলে আগামীতে আরো বড় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
পবা উপজেলার মধুসুদনপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সি এইচ সি পি নুর আলম জানান, এই নদীর পানিতে বাসিন্দাদের গোসল না করতে পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি বলেন, নদীপাড়ের গ্রামগুলোর অনেক মানুষ আমার ক্লিনিকে ডাইরিয়া, দাদ, চুলকানি, পাচড়ার চিকিৎসা নিতে আসে। নদীতে গোসলের কারণে তারা এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই আমি আপনাদের মাধ্যমে সকলকে এই নদীর পানিতে গোলস না করতে অনুরোধ করছি।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য