বৈশাখের মধ্য দিয়ে সূচনা হয়েছে গ্রীষ্মের। বাতাসে গরমের হলকা। বৃষ্টির দেখা নেই বলে গরমে অতিষ্ঠ প্রাণ। আর সে কারণেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হাতপাখা তৈরির কারিগররা। এমনই একদল পাখাশিল্পীর বাস যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শিওড়দাহ গ্রামের মধ্যপাড়ায়।
ঝিকরগাছা অঞ্চলের অনেকেই মধ্যপাড়াকে ‘হাতপাখার গ্রাম’ হিসেবেই চেনে। এখান থেকে তালপাতার হাতপাখা যশোর, সাতক্ষীরা অঞ্চল এমনকি ঢাকা পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই গ্রামের কারিগররা ফরিদপুর থেকে তালের পাতা কিনে আনেন। কয়েকজনের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় একেকটি পাখা। প্রতিটি তালের পাখা পাইকারিতে বিক্রি হয় ২৫-২৮ টাকা দরে। শহরের মানুষ তা কিনে থাকে ৫০-৯০ টাকায়।
সম্প্রতি একদিন ঝিকরগাছার নির্বাসখোলা ইউনিয়নের শিওড়াদাহ গ্রামের মধ্যপাড়ায় গিয়ে পাখা তৈরির কারিগরদের কাজে ব্যস্ত দেখা গেল।
নিজ বাড়ির উঠানে পাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন আঁখি আক্তার। আঁখি জানান, তাঁর স্বামী রুস্তম আলী তালপাতার পাখা ব্যবসায়ী। তিনি বিভিন্ন স্থান থেকে তালপাতা কিনে আনেন। পরিবারের সদস্যরা সেই ডালকে পাখায় রূপ দেন।
রুস্তম আলী বাসাতেই ছিলেন। তিনি জানালেন, পাখা তৈরিতে লাগে সুতা, গুনা বা তার, রং ইত্যাদি। সেলাই, পাতা কেটে আনার মজুরি ইত্যাদির পেছনেও ব্যয় আছে। প্রতি হাতপাখায় লাভ হয় পাঁচ থেকে আট টাকা।
ফারুক হোসেন নামের আরেক কারিগর জানালেন পাখা তৈরির প্রক্রিয়ার কথা। প্রথমে তালের কাঁচা পাতা শুকিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময় সময় পর পাতাগুলো পানি থেকে তুলে চাপাতি দিয়ে কেটে পাখার আকার দেওয়া হয়। তালের হাতপাখা সাধারণত তিন প্রকার হয়। আস্ত ডাঁটি (পাতার পূর্ণ ডাঁটিযুক্ত) হাতপাখা, আধাডাঁটি (পাতার অর্ধেক ডাঁটিযুক্ত) হাতপাখা ও কান্তি (তালপাতার সঙ্গে বাঁশের চটা বাঁধা) হাতপাখা।
ফারুক হোসেন বলেন, একটি তালের হাতপাখা তৈরি করতে পাঁচজন মানুষের হাতের ছোঁয়া লাগে। এরপর সেটি প্রাণ-জুড়ানো শীতল হাওয়ার জন্য তৈরি হয়।
কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পৌষ মাস থেকে তালের পাতা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। হাতপাখা তৈরির কাজ মাঘ থেকে শুরু হয়ে সেই ভাদ্র মাস পর্যন্ত চলে। এই মৌসুমে এরই মধ্যে যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকার অনেক পাইকার এই গ্রাম থেকে তালের পাখা কিনে নিয়ে গেছেন।
বৈদ্যুতিক পাখার প্রসারের মধ্যেও বিদ্যুৎ না থাকলে অনেকেরই ভরসা হাতপাখা। যুগের হাওয়ায় বাজারে এসেছে প্লাস্টিকের হাতপাখা। ঘরে ঘরে উঠছে বৈদেশিক চার্জার ফ্যান। কিন্তু তালের পাখার স্নিগ্ধ বাতাসের আমেজই আলাদা। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ আর ঐতিহ্যপ্রেমী নাগরিকের কাছে এর সমান কদর। নানা প্রতিকূলতার মুখেও ঝিকরগাছার পাখার কারিগররা আবহমান লোকশিল্পের এই মূল্যবান উপাদান টিকিয়ে রেখেছেন।
তারা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তালপাতার পাখা শিল্প টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি নিজেদের স্থিতিশীল জীবিকা নিশ্চিত করতে পারবেন
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য