-->
শিরোনাম
অলওয়েদার সড়কে আলপনা

হাওরের শস্য ও মাছের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্থের আশঙ্কা

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
হাওরের শস্য ও মাছের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্থের আশঙ্কা
হাওরের অলওয়েদার সড়কের ১৪ কি.মি. জুড়ে আলপনা আঁকা হয়েছে

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সম্প্রতি হাওরের অলওয়েদার সড়কের মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার জুড়ে দৃষ্টিনন্দন আলপনা আঁকা হয়েছে। আলপনার এসব রং বৃষ্টিতে ধুয়ে হাওরের পানিতে মিশলে তা হাওরে মাছের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদেরা।

 

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো রঙে স্বাভাবিকভাবে নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে। হাওরের সড়কে আঁকা আলপনায় যে পরিমাণ রং ব্যবহার হয়েছে, তাতে থাকা রাসায়নিকের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেখানকার জলজ উদ্ভিদ, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী।

 

হাওরের অলওয়েদার সড়কে বিশ্বের দীর্ঘতম আলপনা আঁকার কাজটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করেছে ডিজিটাল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন, এশিয়াটিক এক্সপেরিয়েন্সিয়াল মার্কেটিং লিমিটেড ও বার্জার পেইন্টস। ১২ এপ্রিল মিঠামইনের জিরো পয়েন্টে রংতুলির আঁচড় দিয়ে আলপনা আঁকার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর।

 

জানা গেছে, এই আলপনা আঁকার জন্য ১৪ কিলোমিটার সড়কে ১৬ হাজার লিটার রং ব্যবহার করা হয়েছে। আর রঙের সঙ্গে মেশানো হয়েছে প্রচুর পরিমাণে তারপিন। এই তারপিন কেরোসিনের চেয়ে ভয়ংকর।

 

রং ও তারপিনের মিশেলে আঁকা এই আলপনা হাওরের শস্য ও মাছের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে জানিয়ে তখন থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন পরিবেশবাদীরা। তাঁরা বলছেন, হাওর মা মাছের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ জায়গা। বৈশাখের প্রথম বৃষ্টিতে সাধারণত ট্যাংরা, বাতাসি, পুঁটি, মলা, বোয়াল, শোল, গজার, পাবদা, গুলশা, কই, শিং, মাগুরসহ বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ ডিম ছাড়ে। যদি বৃষ্টি হয়, তবে এখানে ব্যবহার করা রং ধুয়ে হাওরের পানিতে মিশে যাবে। এই রং হাওরের পানিতে দ্রবীভূত হয়ে শস্য, মাছসহ জলজ প্রাণী, ঘাস ও পোকা-পতঙ্গের প্রাণ কেড়ে নেবে। মাটি-পানি দূষিত হয়ে বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়বে।

 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘বৈশাখে আলপনার রঙে সাজবে, এটাই বাঙালির চিরায়ত প্রথা। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল পরিবেশ বিপর্যয়ের কথাটা সবার আগে মাথায় রাখা। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, রঙে থাকে টক্সিক কেমিক্যাল। বিশেষ করে বিসফেনলের মধ্যে এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টার (অন্তঃস্রাব বিঘ্নকারী) থাকে, যা পানিতে মিশে মাছের ওপর ভয়ংকর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। যখনই মাছসহ জলজ প্রাণী এই উঁচু মাত্রার বিসফেনলের সংস্পর্শে আসবে, তখনই মাছসহ জলজ প্রাণী ডিম পাড়বে না, ডিম নিষিক্ত করতে পারবে না।’

 

দেশে মাছের চাহিদার প্রায় ১৪ শতাংশ পূরণ হয় হাওর থেকে। এজন্য কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলকে বাংলাদেশের অন্যতম মৎস্যভান্ডারও বলা হয়।

 

জেলা মৎস্য কার্যালয় জানায়, কিশোরগঞ্জের হাওর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৮ হাজার ২১ টন মাছ উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে হাওরের মাটি খুবই উর্বর হওয়ায় এখানে প্রচুর ধান জন্মে। সারা দেশের ধানের চাহিদার ২৫ শতাংশ পূরণ হয় হাওরাঞ্চল থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বোরো ও আমন ধান উৎপাদিত হয় ৪ লাখ ৮২ হাজার ২৮৩ টন।

 

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, রঙের ভেতরে যে সাধারণ উপাদানগুলো থাকে (যেমন-বেনজেন, ডাইক্লোভিশন, সেট্রাক্লোভিশন, টলিউন, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম); সেগুলোয় অনেক ধরণের কেমিক্যাল থাকে। হাওরের ১৪ কিলোমিটার সড়কে যে পরিমাণ রং ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই ওখানকার জলাভূমি, জলজ উদ্ভিদ, মাইক্রোস্কোপিক জলজ প্রাণী, এমনকি ছোট ছোট মাছও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘যেকোনো ধরণের কেমিক্যাল জলজ প্রাণীর জন্য হুমকিস্বরূপ। সেখানে বিশাল এলাকাজুড়ে আলপনা আঁকা হয়েছে; সেটা মাছ এবং অন্যান্য প্রাণীর জন্য অবশ্যই কিছুটা ক্ষতিকর হবে। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের আইন রয়েছে, যেমন বিভিন্ন মিল ফ্যাক্টরির বর্জ্য নদ-নদীর জন্য ক্ষতিকর। আর সে ক্ষেত্রে পরিবেশ আইনেরও প্রয়োগ করা হয়। এসব কাজ করার আগে পরিবেশের কথা বিবেচনা করে সবার আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’

 

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জ জেলার সহকারী পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মতিন বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

 

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version