-->
শিরোনাম

মুনাফার লোভে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ চাষীরা

রাজবাড়ী প্রতিনিধি
মুনাফার লোভে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ চাষীরা

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার চাষিরা দেশি-বিদেশি টোব্যাকো কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে বিষাক্ত তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তামাক চাষ মাটি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও এটি চাষের দিকে ঝুঁকছেন তারা। ফলে উপজেলায় দিন দিন তামাক চাষ বাড়ছে।

 

উপজেলার উজানচর, ছোটভাকলা, দেবগ্রাম, দৌলতদিয়া ইউনিয়ন এবং পৌরসভায় দিনে দিনে ব্যাপক হারে তামাক চাষ বাড়ছে। এতে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘদিন তামাক চাষে জমিতে অন্য ফসল চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও তামাক চাষ করছেন উপজেলার চাষিরা।

 

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে গোয়ালন্দের চারটি ইউনিয়নের মধ্যে দৌলতদিয়ায় দশমিক ৫০ হেক্টর ও উজানচরে তিন হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দৌলতদিয়ায় ১ হেক্টর ও উজানচরে ৪ হেক্টর এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দৌলতদিয়ায় ১ হেক্টর ও উজানচরে ৭ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তাদের হিসাবে দুই বছরে দ্বিগুণ পরিমাণ তামাকের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে উজানচর ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি।

 

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার দুর্গম এলাকাগুলোর কৃষকরাও তামাক চাষে ঝুঁকছেন। অর্থাৎ মাঠ পর্যায়ে তামাক চাষের পরিমাণ আরও বেশি রয়েছে। উপজেলার এসব ইউনিয়নগুলোতে টোব্যাকো কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে চাষিদের দিয়ে তামাক চাষ করিয়ে নিচ্ছে।

 

স্থানীয় তামাক চাষিরা জানান, জমিতে খাদ্যশস্য চাষ করে তারা খুব বেশি লাভবান হতে পারেননি। প্রতি বিঘা জমিতে তামাক চাষে বীজ, সার, কীটনাশক ও পরিচর্যাসহ মোট ব্যয় হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। যার একটা অংশ সহজ শর্তে ব্যয় করে টোব্যাকো কোম্পানিগুলো। দামও ভালো পাওয়া যায়, লোকসানের কোনও আশঙ্কা নেই। এ কারণেই তারা তামাক চাষের দিকে বেশি ঝুঁকছেন।

 

উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের হাবিল মন্ডল পাড়ার কৃষক নেকবার আলি বলেন, তামাক চাষে প্রচুর পরিশ্রম ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে, তবুও বিষাক্ত তামাক চাষ করছি। কারণ, তামাক চাষ ও বিক্রি নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা নেই এবং লোকসানেরও শঙ্কা নেই।

 

মোবারক শেখ নামের এক কৃষক বলেন, গত বছর পাঁচ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছি। পেঁয়াজ ক্ষেতে সাথি-ফসল হিসেবে তামাক চাষ করেছি। তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু লাভও তো বেশি হচ্ছে।

 

উজানচরে স্ত্রী দুই সন্তান নিয়ে তামাক শুকাচ্ছেন মো. হামিদ শেখ। এ সময় তামাক পাতায় বিষ থাকার কথা বললে তিনি বলেন, অন্য ফসলের চেয়ে তামাক চাষে লাভ বেশি। তাছাড়া একদিন তো মরেই যাবো। এ জন্য এখন আর এগুলো করে ভয় পাই না। আমাদের কোনও সেফটি লাগে না। ভাত খাওয়ায় আগে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিই।

 

ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির গোয়ালন্দের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাঠকর্মী মো. মামুন বলেন, কোম্পানি থেকে বিনা মূল্যে কিছু দেওয়া হয় না। কৃষকদের সুবিধার্থে সুদমুক্ত ঋণ হিসেবে একরপ্রতি তামাক রোপণের খরচ বাবদ টাকা, সার, বীজসহ আনুষঙ্গিক উপকরণ দেওয়া হয়। তামাক নেওয়ার সময় এসব টাকা কেটে রেখে বাকি টাকা কৃষককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

 

উজানচর ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা লক্ষ্মণ কুমার বলেন, প্রকৃতপক্ষে হিসাবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি তামাক চাষ হয়েছে। কৃষকদের বোঝানো হলেও তারা বাড়তি লাভের আশায় স্বাস্থ্য ও জমির ক্ষতির চিন্তা না করে তামাক চাষে ঝুঁকছেন।

 

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, তামাক ও তামাকজাত পণ্য শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তামাক থেকে জর্দা, গুল, বিড়ি, সিগারেটসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর পণ্য তৈরি হয়। তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবহারের ফলে মুখে ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি হয়ে ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো ঝুঁকিও থাকে। এ ছাড়া যে এলাকায় তামাক চাষ হয়, তার আশপাশের মানুষেরও শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খোকন উজ্জামান বলেন, তামাক চাষ ক্ষতিকর, এটা কম-বেশি সবাই জানেন। শুনেছি, তামাক চাষিরা সিগারেট কোম্পানির সহযোগিতায় সাথি ফসলের সঙ্গে অধিক মুনাফার জন্য তামাক চাষ করছেন। তামাক চাষ বেড়ে যাওয়ায় আমরা শঙ্কিত। ক্ষতিকর তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করার জন্য মাঠপর্যায়ে নিয়মিত সভা সেমিনার করছি এবং কৃষকদের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে বোঝাচ্ছি।

 

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version