-->
শিরোনাম

জিআই পণ্যের স্বীকৃতি মিলেনি মহেশখালীর বিশ্বখ্যাত মিষ্টি পানের

এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার
জিআই পণ্যের স্বীকৃতি মিলেনি মহেশখালীর বিশ্বখ্যাত মিষ্টি পানের
ক্যাপশন: মহেশখালীর পানের বাজার

জিআই পণ্যের স্বীকৃতি না পাক, তাতে কী! মহেশখালীর মিষ্টি পানের কদর ও চাহিদা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। কিন্তু সুপ্রাচীনকাল থেকে ইতিহাসের পাতায় পাতায় পৃথিবীর বহু ভাষায় পদ্যে, আর গদ্যে, গানে আর ছন্দে পূঁথি সাহিত্যে উঠে আসে, মহেশখালীর মিষ্টিপান বিশ্বসেরা।

 

সেই ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালীর মিষ্টিপানের নাম আসেনি ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ সালে প্রকাশিত জিআই পণ্যের স্বীকৃতির তালিকার। উল্টো রাজশাহীর ঝালপানকে মিষ্টিপান হিসাবে জিআই পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে মহেশখালী পানচাষীসহ কক্সবাজার জেলার মিষ্টি পানচাষীরা চরমভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

 

কক্সবাজার জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে কুতুবদিয়া ছাড়া অবশিষ্ট ৮ উপজেলা ছাড়া ও চট্টগ্রাম এবং বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে মহেশখালীর মিষ্টি পানের বীজ বপনের মাধ্যমে লক্ষাধিক পানচাষী মিষ্টি পানের আবাদ করেছেন। কিন্তু স্বাদে, গুণে, মানে এবং দেখতে মহেশখালীর মিষ্টি পানের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মিষ্টি পান ছাড়াও মহেশখালীতে আরেক ধরনের সুগন্ধিযুক্ত সাচিপান উৎপাদিত হয়। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতবার কক্সবাজার তথা মহেশখালীতে এসেছেন ততবারই মহেশখালীর মিষ্টি পানের গুণগান গেয়েছেন। শুধু তাই নয়, নেতাকর্মীদের কাছে মহেশখালীর মিষ্টিপান আবদার করে চেয়ে নিতেন এবং তৃপ্তি ভরে খেতেন।

 

এদিকে মহেশখালী পানচাষী সমিতির সভাপতি শাহ আলম মহেশখালীর জগৎ বিখ্যাত মিষ্টিপানকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতির তালিকায় স্থান করে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদয় সম্মতি পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একাধিক স্মারকলিপি প্রেরণ করেছেন। তাঁর এ ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নে এক্যবদ্ধ মহেশখালী তথা জেলার লক্ষাধিক মিষ্টিপান চাষী, বিপনন ও পরিবহন শ্রমিকসহ এ পেশায় সম্পৃক্তরা।

 

কৃষিবিভাগের দেয়া তথ্যানুযায়ী, জেলায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে পানবরজের চাষ হচ্ছে। যেখানে মহেশখালীতেই রয়েছে ১৭শ’ হেক্টর পানবরজ। পাহাড়ি অঞ্চলের পান বরজের হিসাব জেলা কৃষি অফিসের দেয়া তথ্যে উঠে আসেনি।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে আরো আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে পানবরজ। পান চাষের উপকরণের মধ্যে রয়েছে, গাছ, বাঁশ, সার, কীটনাশক, শন, পলিথিন, উল, খৈল ও পানি। জেলায় পানচাষীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। বিপণন, শ্রমিক, মধ্যসত্ত্বভোগী মিলে জেলায় আড়াই থেকে তিন লাখ লোক এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত। আনুমানিক ৬০ থেকে ৭০ হাজার পরিবারের অন্ন সংস্থান হয় পানচাষ থেকে।

 

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেও দেখা মেলে মহেশখালী মিষ্টি পানের জনপ্রিয়তার চিত্র। এই উপমহাদেশে ভ্রমণ করতে আসা অনেক পর্যটকের লেখায়ও উঠে এসেছে মহেশখালীর মিষ্টি পানের কথা। আগেকার দিনে রাজা বাদশাদের খাবারের তালিকায় পান ছিল অন্যতম রাজকীয় বিলাসী খাবার। ভারতবর্ষের রাজা-বাদশাদের অন্দরমহলে পান খাওয়ার প্রচলন ছিল বলেও জানা যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান অন্দরমহলের নারীদের কাছে পান খাওয়া জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। পানের গুণগান গাওয়া হয়েছে মধ্যযুগের অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখায়ও।

 

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক গানের রাণী প্রয়াত শেফালী ঘোষ গেয়েছেন, ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম, মইশখালীর পানের খিলি তারে বানাই খাবাইতাম।’

 

বিয়ে-বাড়িতে, বাসায় মেহমানদারিতে, আড্ডায়, ধর্মীয় উৎসবে পান একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আলাদাভাবে। আবার, সনাতন ধর্মের লোককথা অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ পান খেতে পছন্দ করতেন বলে পানপাতাকে শুভ বা কল্যাণকর এবং পবিত্র বলে মানা হয়। এমনকি সনাতন সমপ্রদায়ের বর-কনের চার চোখের মিলন হয় পানপাতা মুখ থেকে সরিয়ে। বিয়ে বা যেকোন আচার-অনুষ্ঠান, শুভকাজ সবক্ষেত্রে বৃহত্তর চট্টগ্রাম কক্সবাজারে পানের ডালা সাজিয়ে বরণ করতে হয় নব বর-বধূকে। পান ছাড়া যেকোন অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণই থেকে যায়।

 

কৃষিবিদ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, এখানের যে লবণাক্ত হাওয়া সেটাই এই পানকে মিষ্টি করে। এই পান ঝাঁঝালো না হওয়ার আরও একটি কারণ হলো এই পান অনেক পাতলা। খেলেই গালে সহজে মিশে যায়। তাছাড়া এখানের মাটিই এমন যে পানগুলো মিষ্টি হয় খেতে। এই পানের মিষ্টি স্বাদ ছাড়াও আকারের পরিবর্তনের সাথে ঘটে দামেরও পরিবর্তন। পান যত বড় দামও তত বেশি।

 

২৫ বছর ধরে পান চাষে যুক্ত কালারমারছড়ার নুরুল হুদা বলেন, পান বরজ থেকে তুলে আনার পর সেগুলোকে আমরা ৩ ভাগে ভাগ করে ফেলি। বড়, মাঝারী ছোট- এইভাবে ভাগ করে দাম নির্ধারণ করে থাকি। বড় পানের দাম বিরা পতি ৫০০ টাকার উপরে হয়ে থাকে। পান বিক্রি হয় বিরা হিসেবে। এক বিরায় পান থাকে ৮০টি। তবে মাঠ পর্যায়ে ১৮০-২০০টি পান দিয়ে বিরা করা হয়। যা খচরা ব্যবসায়ীরা ভেঙ্গে ৭০ থেকে ৮০ পিছ করে বিরা হিসাবে গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রি করে থাকে। ৫০ গণ্ডা বড় পান বিক্রি হয় ৪৫০-৫০০ টাকা, মাঝারী পানের দাম হয়ে থাকে ৩০০-৪০০ টাকা এবং ছোট পানের দাম হয়ে থাকে ১০০-১৫০ টাকা পর্যন্ত। সাধারণত এক গণ্ডায় থাকে ৪টি পান। ৫০ গণ্ডা পানকে এক বিরা হিসেব করে চাষীরা পান বিক্রি করেন। শীতকালে পানের উৎপাদন কম হয় বলে দাম বেশি থাকে আর গ্রীষ্মকালে পান বেশি হয় বলে দাম কম থাকে।

 

কৃষি কর্মকর্তা কায়ছারুল ইসলাম বলেন, পান যখন পরিপক্ক হয়ে উঠে তখন চাষীরা প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর গাছ থেকে পান তুলে নেয়। একসাথে সব পান তুলে ফেলা যায় না। একটা পান গাছ থেকে ৩-৫ টা পান ছিঁড়ে নেয়া যায়। যেখান থেকে পান ছিঁড়ে নেয়া হয় সেখানে আবার ৮-১০ দিন পর নতুন পান হয়। এভাবে করে ১০/১২ দিন পর আবার পান সংগ্রহ করা যায়। প্রতি ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর পান বিক্রি করে চাষিরা সর্বনিম্ন ১০ হাজার আর সর্বোচ্চ লাখ টাকার বেশী আয় করেন যা বছরে কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যায়।

 

মহেশখালী উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষিবিদ নাসেরুল আলম বলেন, পান কীভাবে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখায় যায় তা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছি। এই লক্ষ্য সামনে রেখে পরিবহন সিস্টেমে পরিবর্তনের প্রকল্পও হাতে নিয়েছি। পান দ্রুত পচনশীল পণ্য হওয়ায় সঠিক সংরক্ষণ করতে না পেরে চাষীরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। এই জিনিসটা যাতে কমে যায় সে লক্ষ্যে ফ্রিজিং গাড়ি করে পান কীভাবে বিভিন্ন জায়গায় নেওয়া যায় সেটা নিয়ে পরিকল্পনা করছি।

 

মহেশখালী উপজেলার কৃষিবিদ নাসেরুল আলম বলেন, আমাদের সিগনেচার প্রোডাক্ট হচ্ছে এই পান। এটার উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধিতে যত ব্যবস্থা নেওয়া যায় আমরা নিচ্ছি। পান সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে না পারাও বড় একটি বাধা। এর উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধিতে চাষীদেরকে সাথে নিয়ে কাজ করলে হয়তো আরও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version