‘সিডর-আইলা-মোখা-রেমালে জঙ্গল আমাদের ঢাল হয়েছে। জঙ্গল তো শ্যাষ, পরে কী হবে? ৩০ বছর আগে স্বামী মারা গেছে। প্রতিবছর যখনই বন্যা হয় তখনই আমাদের ঘরের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে সমুদ্রের পাড়ে এই বিশাল জঙ্গল থাকার কারণে আমাদের ঢাল হিসেবে বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এই জঙ্গল। প্রতি বছরই বন্যার কারণে শ্যাষ হয়ে যাচ্ছে জঙ্গলগুলো, আমাদেরতো আর থাকার জায়গা হবে না।’
এভাবেই উপকূলীয় বন ধ্বংসের পর সেখানে লাকড়ি কুড়াতে এসে আক্ষেপ করে কথাগুলো বললেন পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন দক্ষিণ মুসুল্লিয়াবাদ গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব লাইলী বেগম।
শুধু লাইলী বেগমই নয়, উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করা প্রত্যেকটা পরিবারের আক্ষেপ এখন এমনটাই। শুধু রেমাল নয়, বঙ্গোপসাগর সৃষ্ট সিডর, আইলা, ফনি, নার্গিস, মহাসেন, বুলবুল, আম্পান, মোখা, বুলবুলসহ প্রত্যেকটা ঝড় জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হচ্ছে উপকূলীয় মানুষের রক্ষাপ্রাচীরের দায়িত্ব পালন করা এই বনাঞ্চল।
প্রতিবছর দুই থেকে তিনটি ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বনের হাজার হাজার গাছ। এতে একদিকে ধ্বংস হয় বনাঞ্চল, সংকটে পড়ে উপকূলের মানুষ, ভারসাম্যহীন হয় পরিবেশ। তাই পরিবেশবাদী ও স্থানীয়দের দাবি সরকারের উচিত দ্রুত পরিকল্পনা অনুযায়ী বনকে রক্ষা করা।
বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৬ ও ২৭ তারিখ উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৫০ হেক্টর বন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত গাছের সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখ ৩৪ হাজার ৯৯২টি। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি ৮১ লাখ ৩৫ হাজার ৬১৫ টাকা।
ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে কুয়াকাটা, লেম্বুরবন, গঙ্গামতির চরসহ পুরো উপকূল ঘুরে দেখা যায়, শতশত ঝাউগাছ, কেওড়া ও শাল রেন্ট্রি, করমজা, আকাশমনি, জাম, অর্জুনসহ নানা প্রজাতির গাছ উপড়ে পড়ে আছে। এসব গাছ শুধু উপকূলকে রক্ষা করতো তা নয়, পর্যটকরা এসে ছায়াতলে বসে সমুদ্রের গর্জন শুনতো ও নির্মল বাতাসে বসে সমুদ্র উপভোগ করতো। বর্তমানে উদ্যানগুলো সমুদ্রের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে। গাছগুলো এবড়োথেবড়ো পড়ে আছে।
কুয়াকাটার হোসেন পাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. নাসির গাজী বলেন, প্রতিবছর বন্যায় এই জঙ্গল নষ্ট করে ফেলছে। জঙ্গল থাকার কারণে আমরা কিছুটা হলেও রক্ষা পাই। এ বছর রিমালে যে পরিমাণ গাছ নষ্ট হয়ে উপড়ে আছে তাতে আর দুই তিন বছর গেলে বেড়িবাঁধের মধ্যে আর কোনো জঙ্গল থাকবে না। সরকারের কাছে আবেদন যাতে দ্রুত আরও বেশি করে গাছ লাগিয়ে বনকে রক্ষা করা হয়।
ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা পর্যটক লাবিব হাসান বলেন, ৩ বছর আগেও কুয়াকাটায় একবার আসছিলাম, তখন যে বন ছিল তার কিছুই নেই। সমুদ্রের পাশে বন থাকাটা একটি বড় সৌন্দর্য। এটি হারিয়ে গেলে পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নেবে।পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’ (ধরা) এর কলাপাড়ার সমন্বয়ক কামাল হাসান রনি বলেন, সবুজ বেষ্টনী হিসেবে আমাদের রক্ষাকবজ এই বনাঞ্চলের বেশীরভাগ গাছ নষ্ট করে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। এর প্রভাবে বন ধ্বংস হচ্ছে, মানুষের জীবিকার সংকট করছে, বন্যপ্রাণীদের অভয়াশ্রম কমে আসছে। সব মিলিয়ে এটা পরিবেশের বিশাল ক্ষতি বয়ে আনবে।
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও বনদস্যুদের কবল থেকে বনকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। এই চক্রটি বন বিভাগের সদস্যদের সহায়তায় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত গাছগুলোকে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি যেভাবেই হোক বনকে রক্ষা করার।
পটুয়াখালী বনবিভাগের উপ-বন সংরক্ষক মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা অপূরণীয়। যে গাছগুলো পড়ে গেছে তা আমরা ওইখান থেকে সরাবো না। তাতে সয়েল ইরোসন কম হবে। প্রাকৃতিকভাবে রিকভারি হবে। রিকভারি প্ল্যান হিসেবে আমরা ঝাউ গাছ লাগাবো এ বছরই। এছাড়া বন রক্ষায় আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য