প্রজনন মৌসুমেই দূষিত হচ্ছে এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র হালদা নদী। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার পাঁচটি খালের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন কলকারখানা ও গৃহস্থালি বর্জ্য এসে হালদায় পড়ছে। নদীটিকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ এখানে কোনো ধরনের বর্জ্য ফেলা দূরে থাক, নদীর পানি দূষিত হয় এমন কোনো তৎপরতা চালানো যাবে না। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে দূষণ প্রকট হলেও এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো উদ্যোগ নেই।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগরের চান্দগাঁওয়ের বাহির সিগন্যাল এলাকায় জুতা ও প্যাকেজিং কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানকার বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেন, চান্দগাঁও, কুলগাঁও এলাকার কারখানার বর্জ্য এবং আবাসিক এলাকার গৃহস্থালি বর্জ্যও পড়ছে নদীতে। দূষণ প্রতিরোধে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম মসিউজ্জামান বলেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। এখনো পর্যন্ত দূষণের উৎস চিহ্নিত করা না গেলেও তা নিয়ে কাজ চলছে। দোষীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
গবেষকেরা সেখানকার পানির মান পরীক্ষা করে বলছেন, যেখানে গিয়ে এসব বর্জ্য পানিতে মিশেছে, সেখানে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে পাওয়া গেছে ১ মিলিগ্রামের কম। পানিতে কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকতে হলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ থাকতে হয় ৫ মিলিগ্রামের বেশি।
দূষণের কারণে মাছ ধরা, কৃষিকাজ, গোসলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে নদী ও খালের পানি ব্যবহার করতে পারছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। এতে অন্তত তিন হাজার জেলের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রায় এক হাজার একর জমির চাষাবাদ। এ ছাড়া ময়লা মিশ্রিত পানির কারণে চারপাশে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। আবার খালগুলোর পাশে রয়েছে অন্তত ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, নতুন করে পাঁচটি খালের মাধ্যমে হালদায় বর্জ্য মিশে যাওয়ার বিষয়টি তাঁরা অবগত নন। তাঁদের কেউ জানাননি। কোন কোন কারখানা বা কারা এই দূষণের সঙ্গে জড়িত, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার হালদাছড়া (পাহাড়ি ঝরনা) থেকে নদীটির উৎপত্তি। নদীটি চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে এসে মিশেছে। এটি এশিয়ার রুইজাতীয় মাছের সবচেয়ে বড় ও দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র, যেখান থেকে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। সরকার ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম নগরের বাহির সিগন্যাল, অক্সিজেন, কুলগাঁও এলাকার কলখানা এবং গৃহস্থালির বর্জ্য নালা-নর্দমা হয়ে খালে এসে পড়ে। এরপর তা খালে প্রবাহিত হয়ে নদীতে মিশেছে। হাটহাজারীর মদুনাঘাট থেকে অনন্যা আবাসিক এলাকা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় এ রকম বর্জ্য, তৈলাক্ত দুর্গন্ধ পানি তীব্র স্রোতে হালদা নদীর দিকে গড়িয়ে যেতে দেখা যায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরের উত্তর চান্দগাঁও বাহির সিগন্যাল শিল্প এলাকার বেশ কিছু কারখানার নালার সঙ্গে ওসব খালের সংযোগ রয়েছে। এখানে আছে জুতা কারখানা, চামড়া কারখানা, বস্ত্র ও পোশাক কারখানা। ওই এলাকার ধানি বিল, গ্রামের বড় পুকুর, ঘরের পাশের পুকুরে একই রকম বর্জ্য দেখা যায় উত্তর চান্দগাঁও বণিক পাড়া, আচার্য পাড়া এলাকায়। এসব বর্জ্য নগরের বামনশাহী খাল, নালা-নর্দমা ও বিল হয়ে হাটহাজারীর পাঁচটি খালে এসে পড়ে।
খালগুলো হচ্ছে দক্ষিণ মাদার্শা ও শিকারপুরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা কাটাখালী খাল, বুড়িশ্চর ইউনিয়নের খন্দকীয়া, কৃষ্ণ ও শিকারপুর ইউনিয়নের কুইয়াশ খাল ও বাথুয়া খাল। পাঁচটি খাল হলেও এগুলোর মধ্যে সংযোগ রয়েছে। শেষ পর্যন্ত নদীতে গিয়ে মিশেছে তিনটি খাল। এই তিনটি খালের মধ্যে খন্দকিয়া খাল হাটহাজারীর বুড়িশ্চর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর বুড়িশ্চর তালুকদার বাড়ি এলাকায় হালদা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই স্থানের ৫০০ মিটার দক্ষিণে শিকারপুর ইউনিয়ন হয়ে আসা কুয়াইশ খাল ও কৃষ্ণ খাল মিশেছে বুড়িশ্চর এলাকায়।
হাটহাজারীর দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের মদুনাঘাট স্লুইসগেট এলাকায় হালদায় মিশেছে কাটাখালী খাল। এখানে মানুষকে নাকে কাপড় দিয়ে চলাচল করতে দেখা যায়। খালগুলোতে বর্জ্য প্রবাহিত হওয়ার খবর পেয়ে সম্প্রতি পরিদর্শন করেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ সালাম এবং হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ইউনুছ গণি চৌধুরী। তাঁরা কোনো সমাধান দিতে পারেননি। দূষণের ঘটনা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অবহিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
হালদা নদীর দূষণের কারণ ও প্রতিকার খুঁজে বের করতে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে একটি কমিটি করা হয়েছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বামনশাহী খালে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি খালে গিয়ে পড়ছে। পরে তা কুয়াইশ ও চন্দ্র বিল নামের বিল এবং নালা-নর্দমার ভেতর প্রবাহিত হয়ে কুয়াইশ, খন্দকিয়া ও কৃষ্ণ খালের মধ্য দিয়ে হালদা নদীতে ঢুকছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, হালদা নদীর বর্তমান দূষণের অন্যতম কারণ, খালগুলো দিয়ে বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। এটা বন্ধ করা না গেলে নদীটি দূষিত হতেই থাকবে। এই দূষণের জন্য দায়ী কারখানাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করতে হবে।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য