‘সাধারণত জানুয়ারির শেষে আর কুয়াশা পড়ে না। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে গাছে গাছে আসতে শুরু করে আমের মুকুল। কিন্তু এবার ফেব্রুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহেও শীত অনুভূত হয়েছিল। এভাবে মুকুল আসতে আসতে মার্চের প্রথম সপ্তাহও চলে গেল। মুকুল আসার পর মার্চের মাঝামাঝি থেকে টানা প্রায় এক মাস সারা দেশে যে দাবদাহ চলল, তা গত ৭৬ বছরেও দেখা যায়নি। এমন বৈরী আবহাওয়ায় আমের মুকুল ঝরে গেল, গুটি তেমন হলো না। ’ এমনটাই বর্ণনা দিচ্ছিলেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার তুলশীপুর গ্রামের চাষি রহমত উল্লাহ।
রহমত উল্লাহ বলেন, ‘গাছের দিকে তাকালে শুধু পাতা। আম নাই। আমার বয়স এখন ৫৫। আমের এমন খরা জীবদ্দশায় দেখিনি। যে গাছে গতবার ১০ মণ আম পেয়েছি, এবার ৩ মণই হয়নি। কিছু কিছু গাছে তো একটা আমও আসেনি। সব বাগানেরই এমন চিত্র। তাই বাজারে আমের দাম বেশি। তারপরও সার-কীটনাশক আর সেচ দিতে যে খরচ করেছি, সেটা উঠে আসবে না।’
আমচাষি, গবেষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত তিন কারণে এবার সারা দেশে আমের উৎপাদনে বিপর্যয়। এর একটি হলো শীত শেষ হতে ১৫ দিনের বিলম্ব, গুটি ধরার সময় এক মাসের টানা দাবদাহ এবং গাছের ‘একান্তর ক্রমিক ফলন’। ল্যাংড়া, ফজলিসহ নানা জাতের গুটি আমগুলোর ক্ষেত্রে এক বছর আম ধরলে পরের বছর ধরে না। গাছে এক বছর পরপর আম ধরার এই বৈশিষ্ট্যকে কৃষিবিদেরা বলে থাকেন ‘একান্তর ক্রমিক ফলন’। এ ছাড়া আম আসার বছরকে ‘অন ইয়ার’ এবং আম না ধরার বছরকে ‘অফ ইয়ার’ হিসেবেও ধরা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘আমের ফলন এবার নিঃসন্দেহে কম। কৃষি বিভাগের হিসাবে এবার মুকুল এসেছিল ৭০ শতাংশ গাছে। আর গত বছর মুকুল এসেছিল শতভাগ গাছে। সেখানে ‘একান্তর ক্রমিক ফলন’ বোঝা গেছে। তা ছাড়া এবার শীত দীর্ঘ হওয়ার কারণে মুকুল এসেছে দেরিতে। মুকুল থেকে গুটি যখন হয়, তখন দুই দিন বৃষ্টি হয়েছে। একদিন ছিল কুয়াশা।
এতে ক্ষতি হয়েছে। গুটি যখন মটরদানা হচ্ছিল, তখন থেকে টানা এক মাস দাবদাহ। এই হিটে গুটি ঝরে পড়েছে। এবারের আবহাওয়া বড় গাছগুলোর খুবই ক্ষতি করেছে।’
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেশির ভাগ বাগানে বড় বড় গাছ। পুরোনো প্রচলিত জাত হিসেবে এসব বাগানে রয়েছে ল্যাংড়া, ফজলি আর নানা জাতের গুটি আমের গাছ। উন্নত জাত হিসেবে কিছু রয়েছে হিমসাগর আর গোপালভোগ। এসব গাছে এবার ফলন একেবারেই কম। তবে কিছুটা ব্যতিক্রম পাশের জেলা নওগাঁ। গত কয়েক বছরে এই জেলায় পুরোপুরি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাইব্রিড জাতের শত শত বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব বাগানে আছে গৌড়মতি, বারি-৩, বারি-৪, কাটিমন, ব্যানানাসহ নানা জাতের হাইব্রিড আম। কৃষিবিদেরা বলছেন, বড় গাছে এবার ফলন বিপর্যয় হলেও সেভাবে ক্ষতি হয়নি ছোট গাছের।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে সালমা বলেন, ‘বড় গাছের পরিচর্যা করা খুব কঠিন। প্রথমে বৃষ্টি, কুয়াশা আর শীতে যখন ক্ষতি হলো, তখন আমরা চাষিদের কীটনাশক স্প্রে করতে বললাম। বড় গাছে এই কাজটা কঠিন। আবার যখন দাবদাহ চলছিল, তখন গাছের গোড়ায় সেচ দেওয়ার পাশাপাশি পাতায় পানি স্প্রে করতে বললাম। এটাও ছোট গাছের তুলনায় বড় গাছে কঠিন। ফলে বৈরী আবহাওয়ায় পরিচর্যার ঘাটতির কারণে বড় গাছে ফলন কম। আর বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা হাইব্রিড জাতের ছোট ছোট গাছের বাগানের পরিচর্যা সহজ। সে কারণে এসব বাগানে প্রচুর আম আছে, যেটা বড় গাছে নেই।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ড. মোতালেব হোসেন বলেন, ‘রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। গত বছর ‘অন ইয়ার’ ছিল। এবার ‘অফ ইয়ার’। তাই নাটোর, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বড় গাছে ফলন কম মনে হচ্ছে। তবে নওগাঁর ছোট গাছে ফলন স্বাভাবিক আছে।’
ছোট গাছের বাগানের সম্প্রসারণ করে আম উৎপাদনকারী দুই জেলা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জকে রীতিমতো টেক্কা দিচ্ছে পাশের জেলা নওগাঁ। এ জেলার পোরশা, সাপাহার, ধামইরহাট ও পত্নীতলা উপজেলায় ছোট ছোট গাছের হাইব্রিড জাতের আমের ২৫০ বিঘা বাগান আছে মোশাররফ হোসেনের। বড় গাছের তুলনায় তাঁর ক্ষতি কিছুটা কম বলে জানালেন। তবে দীর্ঘ শীত আর খরার কারণে ফলন কমেছে বলেও জানান মোশাররফ।
মোশাররফ হোসেনের মতে, ‘ছোট গাছগুলোতে মুকুল একসঙ্গে আসে না। এবার শীত শেষ হওয়ার পর যে মুকুলটা এসেছিল, সেটা তীব্র দাবদাহে টিকতে পারেনি। পরে দ্বিতীয় দফায় যে মুকুলটা আসে, সেটা টিকেছে। ল্যাংড়া, হিমসাগর, গোপালভোগ, ফজলি ও গুটি আমের ক্ষেত্রে ‘অফ ইয়ার’ দেখা যায়। কিন্তু হাইব্রিড জাতের গাছে ‘অন ইয়ার’ বা ‘অফ ইয়ার’ বলে কিছু নেই। এসব গাছে প্রতিবছরই আম আসে। নওগাঁয় এবার ফলন কিছুটা কম হলেও আম আছে। বাজারে ভালো দামও আছে। এই দামটা শেষ পর্যন্ত পেলে ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কে জে এম আব্দুল আউয়াল দীর্ঘ সময় রাজশাহী অঞ্চলে কর্মরত ছিলেন। আমের উৎপাদন এবার কতটা কম হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের হিসাবে গত বছরের তুলনায় এবার উৎপাদন কম হবে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। আর আমার ব্যক্তিগত হিসাবে উৎপাদন কমবে ৪০ শতাংশ। সরকারের চোখ বড়, অনেক কিছু দেখে হিসাব করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ছোট জায়গা থেকে দেখি।’
আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘এবার শীত বেশি ছিল ১৫ দিন। মুকুল আসার সময়টা দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকতে হয়। এটা ছিল আরও কম। মুকুল বের হওয়া ও ফুল ফোটার সময় দুবার স্প্রে করতে হয়, যেন হপার পোকা গুটি নষ্ট করতে না পারে। কিন্তু এবার হপার পোকাতেও গুটি নষ্ট করেছে। তীব্র দাবদাহেও ক্ষতি হয়েছে। রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই ক্ষতিগুলো দেখা গেছে। আর পাহাড়ে এবার ডিসেম্বরে বৃষ্টি হয়। ফলে সেখানেও আমের ক্ষতি হয়েছে। উৎপাদন এবার সবখানেই কম হবে।’
কৃষি বিভাগের হিসাবে, দেশে আমবাগান আছে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমিতে। গত বছর আমের উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ টন। সরকারি হিসাবে, এবার গত বছরের তুলনায় উৎপাদন কমবে ১৫-২০ শতাংশ। গাছে ফলন কম বলে মৌসুমের শুরু থেকেই এবার রাজশাহী অঞ্চলে সব ধরনের আম গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।
ভোরের আকাশ/মি/সু
মন্তব্য