চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফলন বিপর্যয়ে আমের দাম রেকর্ড করেছে। গত পাঁচ বছরের দামকেও ছাড়িয়েছে বর্তমানে আমের বাজারমূল্য। দাম বেশি হওয়ায় এবার এ ফলটি কিনতে অনাগ্রহ অনেকেরই। বাজারে এখন সর্বোচ্চ ৭ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে আম। তবু চাষিরা বলছেন, ফলন এত কম হয়েছে যে, তারা লোকসানের আশঙ্কা করছেন।
কানসাট দেশের সবচেয়ে বড় আমবাজার। এখানে ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, আম্রপালিসহ আরও কয়েক রকমের আম নেমেছে। বর্তমানে প্রতি মণ ক্ষীরশাপাতি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত, আম্রপালি ২ হাজার থেকে ৪ হাজার, ফজলি ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার, হাঁড়িভাঙ্গা সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৮০০, ল্যাংড়া ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা। মৌসুমের শুরুর দিকে গোপালভোগ বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ হাজার টাকা মণ।
পাঁচ বছর আগে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছিল সুমিষ্ট হাঁড়িভাঙ্গা আম। ২০২০ সালের আমের বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গোপালভোগ বিক্রি হয়েছিল ২৬০০-২৮০০ টাকা, গুটি ৭০০-১২০০, লক্ষণভোগ ৮০০-১০০০, ক্ষীরশাপাতি ২৬০০-৩০০০, ল্যাংড়া ১৬০০-১৮০০, ফজলি ৮০০-২০০০, আম্রপালি ২৪০০-৩০০০, হাঁড়িভাঙ্গা ৩০০০-৩২০০ টাকা প্রতি মণ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার আমের দাম অনেক বেশি। এর কারণ বৈরী আবহাওয়া। যার ফলে আমের ফলন কম হয়েছে। চাহিদার তুলনায় বাজারে কম আছে বলে এই ফলটির দাম অনেক বেশি।
বেশি দামে আম বিক্রি করেও হতাশ বাগানিরা। আম বিক্রির টাকা থেকে উৎপাদন খরচ উঠে আসবে কি না এমন আশঙ্কা জেঁকে বসেছে তাদের মনে। শিবগঞ্জের আমবাগানি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গাছে যখন মুকুল আসে, তখন বাড়তি পরিচর্যা করতে হয়। অন্যের কাছ থেকে বাড়তি টাকায় পানি সংগ্রহের পাশাপাশি বেশি দামে বালাইনাশক কিনে গাছ পরিচর্যা করতে হয়েছে। এবার শ্রমিক খরচও বেড়েছে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলেও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, আমার এক বাগানে ৭০টি গাছ আছে। বাগানটিতে মাত্র ১০-১২টি গাছে আম এসেছে। বাকিগুলোতে মুকুল কম এলেও টেকেনি।
ওই এলাকারই সাইদুর রহমান নামে আরেক বাগানি বলেন, ফলন কম হওয়ায় বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। এটা ঠিক আছে। কিন্তু বেশি দামে বিক্রি করেও উৎপাদন খরচ উঠে আসার সম্ভাবনা দেখছি না। এভাবে চলতে থাকলে আমের ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।
বেশি দামে আম বিক্রি করেও উৎপাদন খরচই উঠে আসবে নাÑ বাগানিদের এই কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও কৃষি উদ্যোক্তা মুঞ্জের আলম মানিক। তিনি বলেন, গাছে মুকুল আসার পূর্বেই পরিচর্যায় অনেক খরচ করেন বাগানিরা। প্রতিবছরই বালাইনাশকের দাম বাড়ছে। এবারও ব্যতিক্রম নেই। ফলে এবার আমের দাম বেশি হলেও অনেক বাগানির উৎপাদন খরচই উঠবে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের ঐতিহ্য বহন করে আসছে পুরোনো বাগানের বড় বড় আমগাছ। কিন্তু চলতি মৌসুমে বড় গাছগুলোতে কাঙ্ক্ষিত আমের দেখা মেলেনি। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এবার আমের জন্য অফ ইয়ার, অন্যদিকে খাদ্যাভাবে বড় গাছে ফলন একেবারেই কম।
চাষিরা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আশ্বিনা, ফজলি, ক্ষীরশাপাতিসহ প্রচলিত আমের গাছগুলো অনেক বড়। কিন্তু এসব গাছে এবার মুকুলের পরিবর্তে ডালের ডগায় কচিপাতা বের হয়েছে। ফলে এবার আমের ফলন অর্ধেকেরও কম।
মুনিরুল ইসলাম নামে এক আমবাগানি বলেন, প্রচলিত যতগুলো আম আছে, তার সবগুলো বড় বড় গাছ। এসব গাছে এবার মুকুল আসেনি। যার কারণে আমের ফলন খুবই কম। বড় গাছগুলোকে কেটে নতুন করে বাগান সৃজন করছেন অনেক কৃষি উদ্যোক্তা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের উপপরিচালক ড. পলাশ সরকার বলেন, গতবার শতভাগ গাছে আম হয়েছিল। যার কারণে সে বছর সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। কিন্তু চলতি মৌসুমে আমের জন্য অফ ইয়ার। ফলে এবার ৩ লাখ মেট্রিক টনের কিছু বেশি আম উৎপাদন হবে।
আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার আমের ফলন খুবই কম। বৈরী আবহাওয়ায় গাছে মুকুল কম হয়েছে। তারপর মুকুল ফুটে যখন গুটি বের হলো, তখন তীব্র খরা শুরু হয়। এ সময় অনেক গুটি ঝরে পড়েছিল। এসব কারণে আমের ফলনে ব্যাপক বিপর্যয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মোকাব্বের আলম নাঈম বলেন, আমের ফলন বিপর্যয় হয়েছে। যার কারণে গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার দাম বেশি।
ভোরের আকাশ/সু/মি
মন্তব্য