-->
শিরোনাম

একটি বাঁধ বদলে দিয়েছে লাখো মানুষের ভাগ্য

দিনাজপুর প্রতিনিধি
একটি বাঁধ বদলে দিয়েছে লাখো মানুষের ভাগ্য
ক্যাপশন : দেশের বৃহত্তম মোহনপুর রাবার ড্যাম

কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে কাজ করছে দেশের বৃহত্তম মোহনপুর রাবার ড্যাম। এর ফলে চাষাবাদের আওতায় এসেছে ১২ হাজার হেক্টরের বেশি অনাবাদি জমি। বেড়েছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। কৃষকের পাশাপাশি সুফল পাচ্ছেন মৎস্যজীবীরাও। গড়ে উঠেছে ড্যামকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প। হয়েছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। সব মিলিয়ে দিনাজপুরের দুই উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের দুই লক্ষাধিক মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে ড্যামটি।

সদর উপজেলার শেখপুরা, উথরাইল, ফাজিলপুর, শশরা, শঙ্করপুর, চিরিরবন্দরের সাইতারা, ভিয়াইল, আউলিয়াপুকুর ও আব্দুলপুর ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আত্রাই নদী। দখল-দূষণে কয়েক দশক ধরে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যেতো। নেমে গিয়েছিল ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ১৯৯৫ সালের পর থেকে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকতো না। আশপাশের পুকুর ও জলাশয়গুলো শুকিয়ে যেতো। নলকূপে উঠতো না পানি। ফলে সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েন এসব এলাকার মানুষজন। বোরো ধানসহ ফসল উৎপাদনে সমস্যায় পড়েন কৃষকরা। অনেক জমি অনাবাদি পড়ে থাকতো। গভীর নলকূপসহ বিভিন্ন উপায়ে সেচ দিয়ে কৃষি আবাদ করতে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেশি পড়তো চাষিদের। খরচ বেড়ে যাওয়ায় ফসল বিক্রি করে লাভের মুখ দেখতেন না কৃষকরা। এ অবস্থায় অনেকে চাষ বন্ধ করে দেন। পাশাপাশি নদীতে পানি না থাকায় মৎস্যজীবীরাও পড়েন বিপাকে। পেশা ছেড়ে অন্য কাজে চলে যান।

এমন পরিস্থিতিতে কৃষিনির্ভর দিনাজপুরে সেচ সংকট কাটাতে ২০১১ সালে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আত্রাই নদীর মোহনপুর ব্রিজ এলাকায় রাবার ড্যাম নির্মাণ শুরু করে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুই বছরে কাজ শেষ হয়। ১৩৫ মিটারের ড্যামটি ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খরা মৌসুমে ড্যাম ফুলিয়ে আত্রাই নদীর ৪৪ কিলোমিটার এলাকায় পানি ধরে রাখা হয়। সেই পানি দিয়ে সদর ও চিরিরবন্দরের ৯টি ইউনিয়নের ১২ হাজার হেক্টর অনাবাদি জমিতে বোরোসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ হয়।

ড্যাম নির্মাণের পরের বছর থেকে সুফল পেতে শুরু করেন কৃষকরা। পানি আটকে রাখায় এখন বছরজুড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিয়ে চাষাবাদ করেন কয়েক হাজার কৃষক। সেইসঙ্গে নদীতে সবসময় পানি থাকায় বেড়েছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। গভীর নলকূপ ও জলাশয়ে থাকছে পানি। দেখা মিলেছে নানা প্রজাতির মাছের। ফলে স্থানীয় মৎস্যজীবীরা আত্রাই থেকে মাছ ধরে, তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

পাশাপাশি ড্যাম ও আশপাশের এলাকার সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছে শত শত মানুষ। এর পাশেই গড়ে উঠেছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র। সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেকের। বদলে গেছে পুরো এলাকার চিত্র। সেইসঙ্গে আর্থ–সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে কৃষি, মৎস্যজীবী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের।

রাবার ড্যাম রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ভুট্টু ইসলাম বলেন, ‘ড্যামের কারণে এলাকার ৯ ইউনিয়নের দুই লক্ষাধিক মানুষের উপকার হচ্ছে। বিশেষ করে সুফল পাচ্ছেন কৃষকরা। আগে পানি ছিল না, এখন সবসময় থাকছে। আবার পর্যটকরা আসছেন। জেলেরা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন।’

সুফল পাওয়ার কথা জানিয়ে আব্দুলপুর ইউনিয়নের কৃষক ভুলু বাবু বলেন, ‘আগে পানি নিচে নেমে গিয়েছিল, এখন ওপরে উঠেছে। নদীর পানি দিয়ে বারো মাস চাষাবাদ করি। ফসলের উৎপাদন ভালো হয়।’

একই ইউনিয়নের কৃষক লিয়াকত আলী বলেন, ‘এখন আগের চেয়ে এখন অনেক সুবিধা হয়েছে। সহজে সেচের পানি দিয়ে জমি আবাদ করছি। আগে অনাবাদি ছিল। ড্যাম দেওয়ায় লাভ হয়েছে জেলেদেরও। আমরাও মাছ ধরি। ড্যাম যখন ছিল না তখন মাছ পাওয়া যেতো না, জমিতে চাষাবাদ করতে পারতাম না।’

সদরের শশরা ইউনিয়নের উমরপাইল জালিয়াপাড়া এলাকার মৎস্যজীবী সুশীল দাস বলেন, ‘আগে তো নদীতে তেমন মাছ পাওয়া যেতো না। রাবার ড্যাম হওয়ার পর থেকে নদীতে পানি বেড়েছে। এখন নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এখন মাছ ধরে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি বিক্রি করে উপার্জনও হয়।’

ড্যামের পাশেই দোকান দিয়েছেন নাজিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আগে রিকশা চালাতাম। কয়েক বছর ধরে এখানে পর্যটকরা আসছেন। তাদের ঘিরে দোকান দিয়েছি। ভালো বেচাকেনা হয়। এ দিয়ে সংসার চলে।’

ড্যামের পাশে রেস্তোরাঁ দিয়ে ব্যবসা করছেন জাহাঙ্গীর আলম দুলু। তিনি বলেন, ‘আগে কৃষিকাজ করতাম। এখানের পর্যটকদের ঘিরে রেস্তোরাঁ দিয়েছি। পর্যটকরা এখানে এলেই আমার রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করেন। ভালোই উপার্জন হচ্ছে। আগে কষ্ট করে সংসার চলতো। এখন অনেক ভালো আছি।’

রাবার ড্যামটি নিয়ে কাজ করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দিনাজপুরের সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ প্রদীপ কুমার গুহ। তিনি বলেন, ‘এর ফলে ৯টি ইউনিয়নের প্রায় সব জমি চাষাবাদের আওতায় এসেছে। সহজ সেচের আওতায় আসায় অতিরিক্ত ১২ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন কমেছে খরচ, সেইসঙ্গে ১০ শতাংশ ফসল উৎপাদন বেড়েছে।’

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় মোট আবাদি জমি রয়েছে দুই লাখ ৭৮ হাজার ৪১৭ হেক্টর। যার মধ্যে এক ফসলি জমি চার হাজার ১৩৯ হেক্টর, দুই ফসলি জমি এক লাখ ৭৮ হাজার ১৪ হেক্টর, তিন ফসলি জমি ৯৩ হাজার ৪৭৯ হেক্টর এবং তিনের অধিক ফসলি জমি দুই হাজার ৭৮৫ হেক্টর।

ড্যামটি কৃষি ও কৃষকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে জানালেন রাবার ড্যাম নির্মাণের পরিকল্পনাকারী জাতীয় সংসদের হুইপ ও দিনাজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম। কৃষিনির্ভর দিনাজপুরে এমন ড্যাম আরও নির্মাণ করা উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ড্যামটি এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যটাই বদলে দিয়েছে। যে নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকতো না, এখন বারো মাস পানি থাকছে। আশপাশের খাল-বিল ও পুকুরেও পানি থাকছে। প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমি আবাদের আওতায় এসেছে। কৃষকরা বারোমাসি শাক-সবজি ও ফসল উৎপাদন করছেন। নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। তা দিয়ে জেলেরা জীবিকা নির্বাহ করছেন। আবার পর্যটকরা এখানে ঘুরতে আসায় দোকানপাট ও ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।’

ড্যাম নির্মাণের আগে এসব এলাকার নারীরা দুই-তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতেন উল্লেখ করে ইকবালুর রহিম আরও বলেন, ‘এখন আর তাদের দূরে যেতে হয় না। সব নলকূপে পানি উঠছে। পানির স্তর ওপরে উঠে আসায় সব পুকুর ও জলাশয়ে পানি থাকছে। এমন ড্যাম এই অঞ্চলে আরও হওয়া উচিত। এতে চাষাবাদ বাড়বে, কৃষকরা লাভবান হবেন এবং কৃষি অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।’

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version