অতি নিবিড় পদ্ধতিতে উচ্চফলনশীল প্রজাতির ভেনামি চিংড়ি চাষ করেছে কক্সবাজারের একটি খামার। সী মার্ক (বিডি) নামক প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি তাদের চাষ করা চিংড়ি প্রথমবারের মতো আহরণ (হারভেস্ট) করেছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি হেক্টরে ৮০ টনের বেশি চিংড়ি উৎপাদন করতে পেরেছে। সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করলে এই জায়গায় পাঁচশ কেজির মতো চিংড়ি পাওয়া যায়।
অর্থাৎ অতি নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ির উৎপাদন বেড়েছে ১৬০ গুণের বেশি। এতে বিশাল সম্পাদনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
চিংড়ি চাষে জড়িতরা বলছেন, অতি নিবিড় পদ্ধতিতে ভেনামি চিংড়ি চাষ অনেক ব্যয়বহুল। এই চাষে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এ কারণে এর ব্যবস্থাপনাও আলাদা। তবে এ পদ্ধতির চাষ বাড়ানো গেলে চিংড়ি রপ্তানি আয় কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও কম মূল্যে চিংড়ি বিক্রি করা যাবে।
জানা গেছে, ভেনামি একটি উচ্চফলনশীল চিংড়ি। উচ্চ ফলনের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধক্ষমতার জন্যও এটি এখন সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে চাষ করা হচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে উৎপাদিত চিংড়ির ৮০ শতাংশই ভেনামি জাতের। দেশে ভেনামির পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয় ২০১৯ সালে। চার বছর ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ চিংড়ির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর অনুমতি দেয় সরকার। এরপর দেশের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা সনাতন ও আধা নিবিড় পদ্ধতিতে ভেনামি চাষের উদ্যোগ নেন। তবে অতি নিবিড় পদ্ধতির চাষ কার্যক্রম প্রথমবারের মতো হাতে নেয় সীমার্ক (বিডি) লিমিটেড।
জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়ায় মেরিন ড্রাইভের পাশে আগে থেকে সী মার্কের একটি হ্যাচারি ছিল। সেটিকেই বৈজ্ঞানিক উপায়ে ভেনামি চাষের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় খামারটির পুনর্নির্মাণকাজ। এ জন্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সীমার্ক। ১২ একরের খামারটিতে রয়েছে তিনটি কালচার পুকুর, ৩২টি নার্সারি পুকুর ও ১৬টি কোয়ারেন্টিন পুকুর। প্রকল্পটিতে আধুনিক সব বৈজ্ঞানিক কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য প্রযুক্তি আনা হয়েছে থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুর থেকে। ভেনামি চাষ করা হয় সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে। এ জন্য বঙ্গোপসাগরের পানি সরাসরি এনে তা পরিশোধন শেষে পুকুরগুলোতে সরবরাহ করা হয়। এর মাধ্যমে সমুদ্রের পানির সঙ্গে আসা সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস দূষণ রোধ করা যায়। খামারে কয়েক ধরনের পুকুর রয়েছে, যেগুলোকে দূষণ ও পরিবেশগত অনিশ্চয়তা থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, খামারের মুখেই বেশ কড়া জৈব নিরাপত্তাব্যবস্থা। গাড়িতে স্প্রে করে ও প্রত্যেককে পরিচ্ছন্ন হয়ে খামারে ঢুকতে হয়েছে। খামারে একটি ল্যাবরেটরি রয়েছে, যেখানে পানি ও চিংড়ির ফিজিকোকেমিক্যাল ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষার সুবিধা রয়েছে। খামারে কোনো নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থ ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় না। এ ছাড়া বর্জ্য পানি ট্রিটমেন্ট না করে পরিবেশে ছেড়ে দেওয়া হয় না। থাইল্যান্ডের চারোয়েন পোকফান্ড ফুডসের (সিপিএফ) প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদেরা এই প্রকল্পে কাজ করেছেন। ভেনামির রেণু (সদ্য জন্ম নেওয়া পোনা), খাবার ও বেশ কিছু প্রযুক্তিও আনা হয়েছে সিপিএফ থেকে। খামারের মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, ভেনামি প্রজাতি সাধারণত রোগজীবাণু সহিষ্ণু। তা সত্ত্বেও এটি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। এ জন্যই এমন নিরাপত্তাব্যবস্থা। তিনি আরও বলেন, বিদেশ থেকে রেণু আনার পরে নার্সারি পুকুরে তা ১৫ দিন লালন-পালন করা হয়। এরপর সেগুলো দেওয়া হয় কালচার পুকুরে। পরে ৬০-১২০ দিনের মধ্যে সেই চিংড়ি বিক্রির জন্য পুকুর থেকে তোলা হয়।
সূত্র মতে, সাধারণত সনাতন, আধা নিবিড়, নিবিড় ও অতি নিবিড়—এই চার পদ্ধতিতে ভেনামি চাষ করা হয়। এর মধ্যে উখিয়ায় অতি নিবিড় পদ্ধতিতে ভেনামি উৎপাদন করছে সীমার্ক। সুপার ইনটেনসিভ হিসেবে পরিচিত পদ্ধতিতে প্রতি বর্গমিটারে ৩৩০টি চিংড়ি চাষ করা সম্ভব, যেখানে সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি বর্গমিটারে সর্বোচ্চ ৫টি চিংড়ি চাষ করা যায়। এ ছাড়া অতি নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ির জীবিত থাকার হার প্রায় ৯০ শতাংশ। চিংড়ি খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সনাতন উপায়ে খামারে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ৫০০ কেজির মতো বাগদা চিংড়ি পাওয়া যায়। আর আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে সর্বোচ্চ ৫-৬ টন পর্যন্ত বাগদা উৎপাদন করা সম্ভব। সেখানে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে প্রতি হেক্টরে ৮-১০ টন ভেনামি চিংড়ি পাওয়া যায়। আর অতি নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টরে ৮০-১০০ টনের মতো ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব। অর্থাৎ ভেনামির উৎপাদনের হার অনেক বেশি।
খুলনায় আধা নিবিড় পদ্ধতিতে ভেনামি চাষ করেছে এমইউ সি ফুডস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, অনেক খামারি এখন আধা নিবিড় ভেনামি চাষের দিকে ঝুঁকছেন। অতি নিবিড় পদ্ধতিতে ফলন অনেক বেশি হলেও এ জন্য বড় বিনিয়োগ ও দক্ষতা প্রয়োজন। তবে সরকার নীতি সহায়তা দিলে নিবিড় পদ্ধতির চাষ আরও বাড়বে। এ বিষয়ে সীমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ বলেন, ভেনামি অনেকটা ব্রয়লার মুরগি বা উচ্চফলনশীল ধানের মতো। যেহেতু আমাদের জনসংখ্যা বেশি এবং জমির সংকট রয়েছে, তাই এমন উচ্চ ফলনশীল চিংড়ি চাষের বিকল্প নেই। বাকি বিশ্বও সেদিকেই যাচ্ছে।
রপ্তানি বাড়ার বিশাল সম্ভাবনা: বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চাষের জন্য চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রথম পুকুরে ভেনামি রেণু ছাড়ে সীমার্ক। এরপর ৮০ দিন পরে তা বিক্রির জন্য তোলা হয়। এ সময় প্রতি কেজিতে ৪০টি করে চিংড়ি পাওয়া গেছে। সীমার্কের উখিয়ার খামার থেকে ভেনামির প্রথম চালান চলে যায় চট্টগ্রামের সীমার্কের প্রক্রিয়াজাতের কারখানায়। সেখান থেকে প্রক্রিয়াজাত শেষে তা রপ্তানি হবে যুক্তরাজ্যে। খুলনা অঞ্চলে উৎপাদিত ভেনামির কয়েকটি চালান অবশ্য ইতিমধ্যে রপ্তানি হয়েছে।
চিংড়িশিল্পের সঙ্গে প্রায় ২৫ বছর ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন সীমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ। প্রক্রিয়াজাত চিংড়ি রপ্তানির জন্য ৯ বার স্বর্ণপদকও পেয়েছেন এই ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানির সূচক অনেক নিচে নেমে গেছে। এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদনের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানগুলো আবার চালু করা সম্ভব। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো ভেনামি চাষে ইতিমধ্যে বেশ এগিয়ে গেছে।
এখনো যদি আমরা শুরু করতে পারি, তাহলে বৈশ্বিক বাজার ধরতে পারব। তবে শুধু দু–চারজন চাষ করলে হবে না। এ জন্য সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের সহযোগিতা পেলে ও চাষিরা বৈজ্ঞানিক চাষে উদ্বুদ্ধ হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ খাতে রপ্তানি আয় ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য