নৌকায় জন্ম, নৌকাতেই মৃত্যু। মরার পর ভিটেমাটিহীন ভাসমান জেলেদের ভাগ্যে জোটে এতিমখানার কবর। জেলেদের নদীতে মাছ ধরতে ধরতেই পুরো জীবন শেষ হলেও ভাগ্যের উন্নয়ন হয় না কখনোই। নদীতে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, রোদ-বৃষ্টি ও তীব্র শীত মোকাবিলা করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাদের।
বরিশাল সদর উপজেলার টুঙ্গীবাড়িয়া ইউনিয়নে কালাবদর নদীর লাহারহাট মোহনায় প্রায় অর্ধশত জেলে পরিবার বেঁচে আছে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে। বহরের একেকটি নৌকায় একেক পরিবারের বসবাস। জেলেদের জন্ম, বড় হওয়া, বিয়ে, সন্তান জন্মদান ও মৃত্যু—সবই এই নৌকার মধ্যেই।
কথা হলো জেলে আ. কাদের সরদারের (৬২) সঙ্গে। তিনি জানান, স্ত্রী, চার ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। পেটের তাগিদে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আড়িয়াল খাঁ, কালাবদর থেকে মেঘনা-তেতুলিয়ায় ঘুরে বেড়ান তারা। তাদের মতোই শতাধিক জেলে পরিবার মেঘনার প্রবল ঢেউ উপেক্ষা করে শিশু, বৃদ্ধদের নিয়েই ইলিশসহ অন্যান্য মাছ শিকারে নামে। এসব মাছ বিক্রি করেই চলে তাদের জীবন-জীবিকা। শুকনা মৌসুম শুরুর পর থেকেই প্রায় দুই মাস নদীতে মাছ না পাওয়ায় এক প্রকার অনাহারে রয়েছে এই ভাসমান জেলে বহর।
জেলে পরিবারের প্রবীণরা জানান, ভিটেমাটিহীন যাযাবর জীবন তাদের। স্থলভাগের মানুষেরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তাদের ডাকে ‘ব্যাবাইজ্জা’ নামে।
লাহারহাট বহরের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি শামছু ঘরামী জানান, নৌকাতে জন্মানোর কারণে তাদের নাম দেওয়া হয়- ‘ব্যাবাইজ্জা’। এ নামটি যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা চিকিৎসা, শিক্ষাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। সন্তানদের পড়াশোনার জন্য স্কুলে ভর্তি করা হলে নদী থেকে তীরে উঠলেই ‘ব্যাবাইজ্জা’ নামে ডাকাসহ নানাভাবে তাদের উপহাস করা হয়। এতে তাদের সন্তানদের মনও ছোট হয়ে যায়। সামান্য বিবাদের কারণে ডাঙায় থাকা লোকজন হামলা চালালে সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হয় তাদের। শিশু থেকে কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবারই একটাই কাজ মাছ ধরে বিক্রি করে পেট চালানো। কিন্তু শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাছের আকাল দেখা দেওয়ায় ধারদেনা ও চড়া সুদে টাকা এনে চলতে হচ্ছে তাদের।
শামছু আক্ষেপ করে বলেন, ভিটেমাটি না থাকায় কোনো এনজিও বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ দেয় না। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ চড়া সুদে ঋণ দিলেও তা শোধ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় তাদের। এছাড়া সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকেও জেলেরা বঞ্চিত। ভোটার আইডি কার্ড থাকলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে সরকারি সুযোগ-সুবিধা চাইতে গেলে তারা তাদের তাড়িয়ে দেয়। তাই তারা কোনো সাহায্য-সহযোগিতার জন্য কারো কাছে যেতে সাহস পান না। আর এভাবে দিন কাটাতে কাটাতে একসময় জেলেদের কেউ মারা গেলে তাকে কোনো এতিমখানার কবরস্থানে কবর দিয়ে আসেন পরিবারের অন্য সদস্যরা।
আবার কোনো জেলে নদীতে মাছ ধরতে গেলে সেই এলাকার ভোটার না হলে তাকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয় সেখানকার লোকজন। তাই অনেকে বাধ্য হয়েই মেহেন্দিগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলার ভোটার হয়েছেন। জেলে হাকিম আলী জানান, স্ত্রী ও শিশু সন্তান নিয়ে গত কয়েক দিন নদীতে নামলেও মাছ মিলছে না। নদীর পাড়ে মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা এনে দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে তাদের। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘সরকার কত লোককে সাহায্য-সহযোগিতা করে, কিন্তু আমাদের ভাগ্যে কিছুই জোটে না।’
জেলে পরিবারের সদস্য আলেয়া বেগম জানান, তার পাঁচ মেয়ের মধ্যে একজন স্বামী পরিত্যক্তা ও অপর এক মেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার স্বামী বৃদ্ধ শামছু ঘরামী প্রতিদিন বিভিন্ন নদী চষে বেড়ালেও মাছ না পাওয়ায় দিন কাটছে তাদের অনাহারে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো সহযোগিতাই জোটে না লাহারহাটের নৌকায় জীবনযাপন করা এসব জেলেদের।
জেলেদের অনেকে বলেন, নদীর তীরে খাসজমি পড়ে থাকলেও তাদের থাকতে দেওয়া হয় না। এসব জমি তাদের বন্দোবস্ত দেওয়া হলে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতে পারতেন। এছাড়া মা-ইলিশের সময় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা ও আট মাসের জাটকা ইলিশ নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি সাহায্য পেলে তাদের অনাহারে থাকতে হতো না।
দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) বরিশাল জেলা সভাপতি শিক্ষাবিদ প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, ভাসমান জেলে পরিবারের সদস্যদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের সব পর্যায় থেকে এগিয়ে আসা উচিত। কেননা নৌকায় থাকা জেলেরাই তো প্রকৃত জেলে। এরা এ পেশায় টিকতে না পারলে পরবর্তীকালে জেলেদের সংকট দেখা দেবে। তিনি নদী-তীরবর্তী জমি জেলেদের বন্দোবস্ত প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বাসদের জেলা সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তীও জেলেদের মধ্যে খাস জমি বন্দোবস্তের দাবি জানান।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য