জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে পড়েছে ভোলার দক্ষিণ উপকূলীয় জনপদ চরফ্যাশন। উপজেলার নদীসমূহের লবণাক্ততা ক্রমশ বেড়ে চলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় পানির উৎসগুলো লবণাক্ত হয়ে পড়ায় পানের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এলাকার মানুষরা এখন এখানে বসবাস নিয়ে চিন্তিত।
চরফ্যাশনের ‘বুড়া-গৌরাঙ্গ, মেঘনা-তেতুলিয়াসহ উপকূলের প্রায় বেশ কিছু খরস্রোতা নদীর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে গেছে। এসব নদীগুলোতে পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও জোয়ার চলাকালীন সময়ে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে।
ঢালচর, চরফ্যাশনের দক্ষিণের নদীতে গড়ে ওঠা একটি চর। ঘূর্ণিঝড় রেমালের পর এখানকার মানুষের উপর নেমে এসেছে এক অভিশাপ। নদীতে জোয়ারের উচ্চতা ও ঢেউ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিদের দাবি গত এক মাসে ইউনিয়নের তিন দিক থেকে (উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম) ভাঙনে প্রায় ৫৫ একর জমি বিলীন হয়ে গেছে। এলাকার পুকুরগুলোতেও প্রবেশ করেছে মিঠা পানির বদলে নোনা পানি। ঝড়-জলোচ্ছাসের তাণ্ডব, জোয়ারের তীব্রতা, নদী-ভাঙন, নদীতে মাছ কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বহু জেলে পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন এই চরে।
এই চরের বাসিন্দাদের একমাত্র পেশা মাছ ধরা। নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন এখানকার জেলেরা। এখন বিকল্প জীবিকা কিংবা এদের নিরাপত্তায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। চরফ্যাশন উপকূল ও ঢালচর এলাকায় নদী ও সাগর মোহনায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এ সংকটের কথা জানা যায়।
জেলেরা জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল এই পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত তাদের অবস্থান বদল করছে। কখনো নদীর ভাঙনে, আবার কখনো ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব এদেরকে বাড়ি ছাড়া হতে হয়। নদীর তীরে বসবাসকারী অধিকাংশ জেলে পরিবার বছরে একাধিকবার বসতি বদলাতে হয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোস্ট ট্রাস্টের গবেষণা তথ্যে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্যোগ এবং নদীতে মাছের অপ্রতুলতার কারণে জেলেরা উপার্জন অক্ষম হয়ে পড়ে। অনেক সময় ঝড়ের কবলে পড়ে জাল-নৌকা সবই হারিয়ে ফেলেন। অথচ অনেকে এই জাল-নৌকা সংগ্রহ করেছেন ধারদেনা করা টাকায়। ফলে এদের ঋণের বোঝাও বাড়ছে।
চরফ্যাশনের ঢালচর ঘাটের জেলে ইউসুফ আলী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জীবিকার ধরণ বদলে গেছে। ঝড়-বন্যায় এখন আর নদীতে বেশি সময় মাছ ধরা যায় না। ঝড়ের সিগন্যাল পেলে মাছ ধরা ফেলে রেখে কিনারে চলে আসতে হয়। আবার কখনো কখনো নিম্নচাপের সংকেত থাকলে জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে যাওয়া সম্ভব হয় না।
একই এলাকার জেলে মোহাম্মদ আলী বলেন, ঝড়-জলোচ্ছাসে নদীর পাড়ে বসবাসকারী জেলেদের জীবন ওলট-পালট করে দেয়, বাড়িঘরে পানি ওঠে। প্রবল বাতাসে ঘর উড়িয়ে নেয়। তখন মাছধরা তো দূরের কথা, ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ছুটতে হয়। নদীতে মাছও কমে গেছে।
ঢালচর, কুকরি, চরমাদ্রাজ ইউনিয়নের মেঘনার তীরে ঝড়-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ জনপদে শতশত জেলের বসবাস। মেঘনা নদী আর সমুদ্রে জাল ফেলা, জালে ওঠা মাছ বাজারে বিক্রি করা, এভাবেই বছরের পর বছর জীবিকা নির্বাহ করছে তারা। জলবায়ু পরিবর্তনে নদীতে মাছ শূন্য সহ নানামুখী দুর্যোগে তাদের স্বাভাবিক জীবিকায় সংকট দেখা দিয়েছে।
চরফ্যাশন মাদ্রাজ ইউনিয়নের সামরাজ ঘাটে মেঘনা থেকে ছোট্ট খাল ঢুকেছে ঘাটের কিনার ঘেঁসে। পড়ন্ত বিকেলে মাছধরা নৌকাগুলো খালের ভেতরে অলস পড়ে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রবল জোয়ার ও জোয়ারের উচ্চতা বেড়েছে বলে জানান এই এলাকার জেলেরা। ঢালচরের মেঘনা তীর ধরে তাদের লন্ডভন্ড বসতি দেখেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। বারবার মেঘনা থেকে উপচে পড়া জোয়ারের পানি জেলে বসতির জীবনধারা বদলে দিচ্ছে।
উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সমুদ্র-উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেলে আমাদের দেশের ১৮ শতাংশ পানিতে নিমজ্জিত হবে এবং সরাসরি ১১ শতাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় একশ কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রতি ৭ জনে একজন জলবায়ু পরিবর্তনের শিকারে পরিণত হবে। এ অবস্থা মোকাবিলায় দক্ষিণ উপকূলের সবগুলো বড় নদী ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে নদীগুলোর স্বাভাবিক গতি বজায় থাকবে, নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ হবে, ডুবে যাওয়া কৃষি জমি পুনরুজ্জীবিত হবে নদীগুলো নৌ-চলাচলের উপযোগী থাকবে মাটির বাঁধ নির্মাণ করা হবে এবং সেগুলোকে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উঁচু করা হবে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হবে যাতে তারা শহরগুলোতে ভিড় না জমায়।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য