-->

বালুখেকো রউফ চেয়ারম্যানের দাপটে মানুষ অতিষ্ঠ

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
বালুখেকো রউফ চেয়ারম্যানের দাপটে মানুষ অতিষ্ঠ

বালুখেকো এক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানের ক্ষমতার দাপটে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। এই চেয়ারম্যান নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঝিনাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় তীব্র ভাঙনের ফলে ফতেপুর বাজারের একাংশসহ একই গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে বহু পরিবার হারিয়েছে বসতভিটা। ক্ষমতাধর এ চেয়ারম্যানের নাম আবদুর রউফ। তিনি সদ্যক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের হাইব্রিড নেতা এবং ফতেপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। সরকারি অনুমতি ছাড়া প্রশাসনের নাকের ডগায় বছরের পর বছর বালু উত্তোলন করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বরং স্থানীয় কেউ প্রতিবাদ করলে চেয়ারম্যানের লোকজন তার ওপর নির্যাতন চালাতেন এবং প্রশাসনও তাদের হয়রানি করতো।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আব্দুর রউফ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় সরকারের মাঠপর্যায়ের নির্বাচনের আগে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে ৩ নং ফতেপুর ইউপির চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক নৌকা পান। এরপর একপ্রকার গায়ের জোরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ইউপি চেয়ারম্যান ছাড়াও বর্তমানে ফতেপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতিও তিনি। অত্যাচারী ও বালুখেকো রউফ চেয়ারম্যানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মির্জাপুর-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খান আহমেদ শুভ।

সরেজমিনে পরিদর্শনকালে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, রউফ চেয়ারম্যানের ভয়ে এলাকার কেউ মুখ খুলতে পারে না। নিষিদ্ধ ভেকু মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন থেকে শুরু করে মানুষের জমি দখল ও চাঁদাবাজি এবং গ্রাম্য সালিশের নামে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের মতো নানা অপরাধের সঙ্গে তিনি জড়িত। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ফতেপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের অনেক বাসিন্দাকে অত্যাচার করার অভিযোগও রয়েছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে সৃষ্ট নদীভাঙনের ফলে শুধু গত বছরের জুনেই ১৮টি বসতবাড়ি এবং ফতেপুর বাজারের এক বিশাল অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং বালু বিক্রির অবৈধ টাকার জোরে স্থানীয় প্রশাসনকে এতোদিন প্রভাবিত করে রেখেছিলেন। যে কারণে তার বিরুদ্ধে আজও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি বলেন, গত বছর ২০ জুন ঝিনাই নদীর ফতেপুর এলাকায় তীব্র ভাঙন শুরু হয়। এতে ২০টি দোকান ও ১৮টি বাড়িসহ সড়কের একাংশ বিলীন হয়ে গেছে। একই কারণে ঐতিহ্যবাহী ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরো কিছু গুরুতপূর্ণ স্থাপনা হুমকির মুখে রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফতেপুর পালপাড়া, বাদ্যকরপাড়া, বানকাটা ও সুতানড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা জানান, রউফ চেয়ারম্যানের অবৈধ বালু তোলার কারণে নরেন পালের বাড়িসহ বাজারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নদীগর্ভে চলে গেছে। একইসঙ্গে সুতানড়ী ও বানকাটার অনেক বসতবাড়ি ঝিনাই নদীতে বিলীন হয়েছে। সর্বস্বহারা পরিবারগুলোকে ক্ষতিপুরণ দেওয়ার কথা বলা হলেও চেয়ারম্যানের অনিচ্ছায় প্রশাসন তা দেয়নি বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। তারা বর্তমান অন্তরবর্তীকালীন সরকারের কাছে নানা অপকর্মের জন্য রউফ চেয়ারম্যানের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর রউফ ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিরীহ মানুষের ওপর জোর-জুলুম অত্যাচার শুরু করেন। নিরীহ মানুষের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া, বালি ও মাটির ব্যবসা, সরকারি বিভিন্ন বরাদ্ধ লুটপাট ও সরকারি টাকা আত্মসাতসহ অপরাধমূলক নানা কর্মকান্ড চালিয়েছেন। রউফ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুস্থদের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির (ভিজিএফ) চাল কম দেয়া, নিজের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে সরকারি সহায়তা বেশি বেশি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফতেপুর ইউনিয়নের তিনজন ইউপি সদস্য জানান, রউফ চেয়ারম্যানের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, বেআইনি ও অবৈধ কর্মকান্ডের বিষয়ে তাকে সাবধান করা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাতে কখনো কর্ণপাত করেননি। তার বিরুদ্ধে এতোসব অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এলাকার কতিপয় মতলববাজ মাতবরকে বশে রেখে বহাল তবিয়তে থেকে অপকর্ম চালিয়ে গেছেন।

রউফ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবজি ও লাগামহীন দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ করেন তার নিজগ্রাম ফতেপুরের অনেক বাসিন্দা। এমনকি দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে এক সাংবাদিক পরিবারকে হয়রানি, হুমকি-ধামকি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানোর ভয় দেখানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি ওই সাংবাদিকের বাড়িতে ঘর নির্মাণ করতেও দেননি চেয়ারম্যান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। তার হাতে বেশি নির্যাতন ও ক্ষতির শিকার হয়েছে এলাকার নিরীহ লোকজন ও সংখ্যালঘু পরিবার। চেয়ারম্যানের অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা বলেন, রউফ সম্পর্কে কিছু বলা মানে নির্যাতনের মুখে পড়া। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন নির্যাতিতরা।

ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল কারীম বলেন, হেন অপকর্ম নেই যা রউফ চেয়ারম্যান করেননি। ইউনিয়নবাসী বিশেষ করে ফতেপুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তার দাপটে তটস্থ, তার ভয়ে কথা বলতে পারে না। আমার পরিবারও এই রউফের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। আমার বাড়িতে ঘর তুলতে দেননি এই বালুখোকা চেয়ারম্যান। এইসব অপকর্ম মির্জাপুর-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খান আহমেদ শুভ‘র ইন্ধনে করতেন তিনি। আমি তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমার কাছে এ সংক্রান্ত ফোনকলের রেকর্ড ও ডকুমেন্টস রয়েছে। এখন সময় এসেছে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার।

জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আবদুর রউফ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি মুঠোফোনে ভোরের আকাশকে বলেন, ‘ঝিনাই নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের তথ্য সঠিক না। এ প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, বর্ষাকালে ভেকু মেশিন দিয়ে কীভাবে বালু উত্তোলন করা যায়?’ বর্ষাকালে নয়, কয়েক বছর যাবত আপনি বালু উত্তোলন করছেন- এমন কথা বলা হলে রউফ চেয়ারম্যান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি বালু উত্তোলন করছি কি না, আপনি নিজে এসে দেখে যান।’

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকতার (ইউএনও) সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version