-->

বৃষ্টির পানি ও নদীভাঙনে সাতক্ষীরার ৭০ গ্রাম প্লাবিত

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
বৃষ্টির পানি ও নদীভাঙনে সাতক্ষীরার ৭০ গ্রাম প্লাবিত

সাতক্ষীরায় বৃষ্টির পানি এবং নদীভাঙনে সদর ও তালা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা নিমজ্জিত হয়েছে। বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় সাতক্ষীরা পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ড, সদরের ১০টি ইউনিয়ন ও তালা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের মোট ৬০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ছয় হাজার মাছের ঘের, দেড়হাজার পুকুর ও কাঁকড়ার হ্যাচারী ছাড়াও আমন ধান ও শাকসবজীর ক্ষেত ভেসে গেছে। পানিবন্ধি হয়ে পড়েছে ১০হাজারের বেশি পরিবার। বুধবার বিকেল থেকে আবারো টানা বৃষ্টিতে নতুন করে পানি বাড়তে শুরু করেছে। জমা পানি বিষাক্ত হয়ে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বৃদ্ধ ও শিশুরা। বাড়ছে জনদুর্ভোগ। মৎস্য ও কৃষি খাতে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও জেলা মৎস্য অধিদপ্তর।

সাতক্ষীর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত সপ্তাহের শনি থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত চার দিনে ৯৬ ঘণ্টায় ২৫৬ মিলিমিটার ও গত বুধবার ভোর থেকে বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত ৩২মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার দিনে ৯৬ ঘণ্টায় ২৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় সাতক্ষীরা জেলায়। ভারী বর্ষণের কারণে ১৫ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার বিনেরপোতা এলাকার শ্মশানঘাটের পাশের বেতনা নদীর পাউবোর রিংবাঁধ ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। এছাড়া বুধবার ভোর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নতুন করে টানা বৃষ্টিতে এলাকায় পানি বেড়েছে। ২৬ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টা পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ সংস্কার করতে পারেনি।

অতি বৃষ্টি ও বাঁধ ভেঙে তালা উপজেলার মাগুরা, নগরঘাটা, খলিশখালি ইউনিয়নের আটুলিয়া থেকে মাগুরা বাজার সড়ক, মাদ্রা থেকে বালিয়াদহ, কলাগাছি থেকে মুড়াগাছা সড়ক ছাড়াও আহসাননগর হরিণখোলাসহ কয়েকটি গ্রামের ইটের সোলিং রাস্তাসহ বেশ কয়েকটি রাস্তা তলিয়ে গেছে। উপজেলার বিনেরপোতা, আহসাননগর, হরিণখোলা, গাছা, দক্ষিণ নগরঘাটা, হাজরাতলা, পালপাড়া, গাবতলা, দোলুয়া, নগরঘাটা, রথখোলা, কাপাসডাঙ্গা, মাদ্রা গুচ্ছগ্রাম, নিমতলাসহ কমপক্ষে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সাতক্ষীরা পৌরসভাসহ পুরাতন সাতক্ষীরার ছাকার মোড় থেকে শাল্যে, মাছখোলা, তালতলা থেকে গোপীনাথপুর ডেইয়ের বিল, কাটিয়া মাঠপাড়া থেকে গদাই বিল, রথখোলা সড়ক, কামানগর, মধুমোল্লারডাঙিসহ বেশ কয়েকটি রাস্তা পানির তলায়। ওইসব রাস্তা দিয়ে গাড়ি তো দূরের কথা, মানুষ চলাচল করতে পারেছ না। এ ছাড়া সাতক্ষীরা সদরের ঘুড্ডেরডাঙ্গী, রামচন্দ্রপুর, লবণগোলা, পাথরঘাটা, দামারপোতা, জিয়ালা, ধুলিহর, বালুইগাছা, ফিংড়ি, ফয়জুল্লাহপুর, দরবাস্তিয়া, কোমরপুর, তেঁতুলডাঙ্গী, খেজুরডাঙ্গা, গোপীনাথপুর, গোয়ালপোতা, তালতলাসহ ৪০টি গ্রাম ও পৌর এলাকার অর্ধেক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ২০-২৫হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ওই এলাকাসহ সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকার মাছ ও কাঁকড়ার ঘের তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে পুকুর, আমন ধান ও শাক-সবজির ক্ষেত।

জলাবদ্ধতা নিরসনে ২৬ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে এক নাগরিক সংলাপে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীতে জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানো, সাতক্ষীরা পৌরসভাকে পুরোপুরি ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রাণসায়ের খালের দুই মুখ উন্মুক্ত করে স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানো, আন্তঃনদী সংযোগ বিশেষ করে ইছামতি, মরিচ্চাপ, খোলপেটুয়া, বেতনা, শালিখা ও কপোতাক্ষকে খননের আওতায় এনে চিরায়ত নিয়মে পানিপ্রবাহ সচলকরণ, নদীগুলোর সাথে সংযুক্ত খালগুলো পুনঃখনন করে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি, অকেজো হয়ে পড়ে থাকা স্লুইসগেটগুলো সংস্কারকরণ, পৌর এলাকার মধ্যে মৎস্য ঘের নিষিদ্ধকরণ, নদীগুলো খননের সঙ্গে সঙ্গে সংলগ্ন বেড়িবাঁধগুলোও টেকসই করে বেড়িবাঁধ ভাঙন রোধ, বেড়িবাঁধে বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ, নদী ও খালের প্রবাহ বিঘ্নিত হয় এমন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ না করা, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের আগেই পানি নিষ্কাশনের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিরুপণের মাধ্যমে জলবায়ু ফান্ডের অর্থ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, চলতি আমন মৌসুমে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে পাঁচ হাজার ৪৫২ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১৪৯ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চলতি আমন মৌসুমে মাঠের শাকসবজি সহ ৯৮ হাজার ৭৮৩ হেক্টর জমির লাগানো ধানের মধ্যে অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ৫ হাজার ৪৫২ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১৪৯ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার বাজার মূল্য ৯ কোটির উর্ধে। এখানে কৃষক সংখ্যা রয়েছে ৫ হাজার ৩৫০ এর মতো। সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার মো. আনিছুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরা জেলায় অতিবৃষ্টির কারণে সদরের বেতনা নদীর একটা অংশ ভেঙে যাওয়ার কারণে আশপাশের মৎস্য ঘেরগুলো একেবারে পানির সাথে মিশে গেছে। এখানে আমাদের মোট ৫ হাজার ২৩০ হেক্টর এরিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ভেসে গেছে অধিকাংশ মাছ এবং এতে মৎস্য চাষীদের ৭০০ কোটি টাকার অধিক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে সেটিও ৪ কোটি টাকার অধিক। এ ক্ষতির হাত থেকে চাষীদের রক্ষা করতে সহজ শর্তে যদি ঋণের ব্যবস্থা করা যেত, অথবা তাদের প্রণোদনার আওতায় আনা গেলে চাষিরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version