খুলনায় দুই দশক পর খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) নিয়ন্ত্রনে থাকা রূপসা ঘাট রাজণৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জোরর্পূবক ও হামলা চালিয়ে দখল নিয়েছে অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)’র ঠিকাদার। দীর্ঘ ১৫বছর পর গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিআইডব্লিউটিএ’র ঠিকাদারের দলবল কেসিসি’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের উপর হামলা ও মারপিট করে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এ ঘাটের দখল নেয়। ঘাটের দখল নিয়ে সরকারের দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, মামলা ও হাঙ্গামার ঘটনায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে কেসিসি কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে ঠিকাদার নিয়োগ ও জোরপূর্বক ঘাট দখল এবং হামলা ও মারপিটের ঘটনায় সদর থানায় ও স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ দায়ের করেছে। বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, তাদের আওতাধীন রূপসা ঘাট দীর্ঘদিন ধরে কেসিসি কর্তৃপক্ষ বিগত সরকারের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে ও জোরপূর্বক দখল করে রাজস্ব আদায় করেছে। সরকার পরিবর্তনের পর বিআইডব্লিউটিএ তাদের নিয়মানুযায়ী ঘাটের ঠিকাদার নিয়োগ করে রাজস্ব আদায় করছে।
এদিকে, বিআইডব্লিউটিএ’র অফিসাররা একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে দখলবাজির এ কাজ করছেন বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের। এই ঘাটের দখল নিয়ে যেকোন সময়ে আরও ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনার আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
কেসিসির রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর সাথে রূপসা উপজেলাসহ পূর্বপাশের কয়েক লাখ মানুষের শহরকেন্দ্রীক যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম রূপসা ফেরীঘাট। গত ২০০৫ সালের ১২ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের নীতিমালার আলোকে রূপসা খেয়াঘাটের ব্যবস্থপনার দায়িত্ব খুলনা সিটি কর্পোরেশনকে প্রদান করা হয়। পরে খানজাহান আলী ব্রিজ চালু হলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের মালিকানধীন পশ্চিম রুপসা ফেরিঘাট, ঘাট সংলগ্ন চত্বর ও সন্নিহিত এলাকার জায়গা খুলনা সিটি কর্পোরেশনকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। কিন্তু খুলনা জেলা পরিষদ রুপসা ঘাটের টোল আদায়ের জন্য ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেয়। এসময়ে কেসিসি আপত্তি জানিয়ে খুলনা যুগ্ম জেলা জজ ১ম আদালতে মামলা(দেঃ ৪০/০৫) দায়ের করলে আদালত কেসিসি’র পক্ষে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেয়।
পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ৪ জুলাই রূপসার উপজেলা নির্বাহী অফিসার পুনরায় ঘাটের ইজারা প্রদানের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে আদালত পুনরায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয়। পরে রুপসা উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেলা জজ আদালতে মিস আপীল মামলা নং ৯৮/০৭ দায়ের করলে আগের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিত করলে ২০০৮ সালের ৯ মার্চ জেলা প্রশাসন ও কেসিসির দায়েরকৃত দুটি মামলাই প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তীতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে কেসিসি’র নিয়ন্ত্রণে রূপসা খেয়াঘাট ইজারা ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে আসছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লিউটিএ কোন আপত্তি জানায়নি।
কেসিসি কর্তৃপক্ষ রূপসা ঘাটে চলচলকারীদের জনদূর্ভোগ লাঘবে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট কেসিসি'র ৭ম সাধারণ সভার সিদ্ধান্তক্রমে ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খেয়াঘাটে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
পরবর্তীতে খুলনা জেলা পরিষদ ২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী ভট্টচার্য-শুলপুর-চন্দনীমহল খেয়াঘাট, কালীবাড়ী খেয়াঘাট, কাষ্টমঘাট খেয়াঘাট, নগরঘাট/রেলীগেট খেয়াঘাট (দৌলতপুর-মহেশ্বরপাশা), বার্মাশিল খেয়াঘাট ( দৌলতপুর-মহেশ্বরপাশা), ষ্টীমার ঘাট খেয়াঘাট (মহসিন মোড়), দৌলতপুর বাজার খেয়াঘাট, রূপসা খেয়াঘাট ও জেলখানা ঘাটসহ ৯টি খোয়াঘাট ইজারা প্রদানের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তখন কেসিসি ঘাটগুলোর ইজারা কার্যক্রম বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে জেলা পরিষদকে পত্র দেয়। পরে জেলা পরিষদ রূপসা ফেরিঘাট কেসিসিকে সওজ কর্তৃপক্ষ হস্তান্তর করেছে তা অবগত নয় এবং ২০০৩ সালের স্থানীয় সরকার বিভাগেরর জারীকৃত নীতিমালা অনুযায়ী রূপসা ঘাটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলে জানায়। একই সাথে জেলা পরিষদ রূপসা ঘাট নিয়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের সিভিল রিভিশন ৪৫৭/২০১৬ নং মামলা বিচারাধীন এবং উক্ত মামলায় জেলা পরিষদের পক্ষে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে কেসিসিকে অবহিত করে। যার বাদী খুলনা জেলা পরিষদ এবং বিবাদী বংলাদেশ অভ্যন্তরিন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ। পরে জেলা পরিষদের পক্ষে মামলার আদেশের বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএ দেওয়ানী আপীল ১৫৯/২০১৩ নং মামলা দায়ের করে। এ আপীল মামলায় নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের পক্ষে রায় দেয় আদালত। উল্লিখিত মামলার কোনটিতেই কেসিসি কোন পক্ষভূক্ত নয় এবং কেসিসি'র বিরুদ্ধে কোন নিষেধাজ্ঞাও নেই।
কেসিসি’র স্টেট অফিসার গাজী সালাহউদ্দিন জানান, জেলা পরিষদ ও বিআইডব্লিউটিএ’র মামলায় কেসিসি’র বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় ২০০৯ সাল থেকে কেসিসি’র নিয়ন্ত্রণে রূপসা খেয়াঘাট ইজারা ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে আসছে। রূপসা ফেরীঘাটের দুইপাড়ের উন্নয়নে ও টোলপ্লাজা র্নিমানে কেসিসি ১০কোটি টাকারও বেশী ব্যয় করে পরিবেশ সুন্দর করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ৯ আগস্ট বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ কোন কিছু না জানিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সহায়তায় অবৈধভাবে ও দূর্নীতির মাধ্যমে কেসিসি’র নিয়ন্ত্রিত রূপসা ঘাটের ইজারাদার নিয়োগ দেয়। পরে ৯ আগস্ট ঢাকার মিরপুরের মো. সোলায়মান শেখের ছেলে শেখ আলী আকবর এক মাসের জন্য ইজারাদার দাবী করে কেসিসি’র প্রশাসক বরাবর রূপসা ঘাটের টোল আদায়ে সহযোগীতার জন্য আবেদন করে। পরবর্তীতে একটি রাজণৈতিক দলের জেলার র্শীষ নেতার সহযোগীদের নিয়ে কথিত ইজারাদার আলী আকবর দলবলসহ দুষ্কৃতকারীরা ১৪ আগস্ট রূপসা ঘাটে কেসিসি’র নিয়োজিত টোল আদায়কারীদেরকে মারধর করে। এসময় দুষ্কৃতকারীরা কেসিসি’র কর্মীদের মোবাইল ফোন ও আদায়কৃত ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক টোল ঘর দখল করে নেয়। ইজারাদারসহ দুষ্কৃতকারীদের মারপিটে টোল আদায়কারী এম.এম মইদুল ইসলাম, মোঃ ইউনুচ শেখ ও মো. ইসলাম মোল্লা আহত হয়। এসময় টোল ঘরসহ ঘাটের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপিত সিসি ক্যামেরা ভাংচুর করে। এ হামলা ভাংচুর, লুটপাট ও ঘাট জোরপূর্বক দখলের বিষয়ে টোল আদায়কারী এম.এম মইদুল ইসলাম কেসিসি’র পক্ষে খুলনা সদর থানায় ও যৌথ বাহিনীর সিও বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন।
এদিকে, রূপসা ঘাটের দখল নেওয়ার পর ইজারাদার ও তার লোকজন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নির্ধারিত তালিকার চেয়ে বেশি অতিরিক্ত টোল আদায় করছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এছাড়া চলাচলকারী মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার ও হয়রানিরও অভিযোগ উঠেছে। তাদের দাবী, বিআইডব্লিউটিএ’র খুলনার পরিচালক অনৈতিক লেনদেন ও দুর্নীতির মাধ্যমে একটি পক্ষকে লাভবান করতে রূপসা ঘাটের নতুন করে ইজারাদার নিয়োগ দিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করছে।
রূপসা ঘাটে চলাচলকারী খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ মোহাম্মদ শাফিকুজ্জামান জানান, তার কাছ থেকে ইজাদারের লোকজন ২ টাকা নিয়েছে। ঘাটের টোল ১টাকা হলেও বাকী ১ টাকা ফেরত দেয়নি।
রূপসার প্রিন্টিং প্রেস ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান জানান, সিটি কর্পোরেশনের আদায়কারীদের ব্যবহার ভাল ছিল এবং একটা সিষ্টেমের মধ্যে ছিল। কিন্তু এখন যারা টোল আদায় করছে তাদের আচার-ব্যবহার সন্তোষজনক নয়-মারমুখী আচরণ করছে। ফকিরহাটের বেকারী ব্যবসায়ী বাবুল খান ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, সাইকেলসহ ৫ টাকা টোল নিয়েছে। কিন্তু আগে টোল কম ছিলো। সাধারণ মানুষে সুবিধা হতো। টোল আদায়কারীদের রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় অনেকের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে প্রতিনিয়ত।
রূপসাঘাটের ইজারাদার শেখ আলী আকবরের টোল আদায়কারি মীর মোহাম্মদ সোহেল রানা জানান, আমরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এক টাকা, সাইকেল ২ টাকা, মোটরসাইকেল ৫ টাকা আদায় করছি। অন্যান্য মালামালের জন্য কোন টাকা নেয়া হয়না। যদি কেউ খুশি হয়ে দেয় তাহলে নিয়ে থাকি।
খুলনা বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের আকাশকে জানান, তাদের আওতাধীন রূপসা ঘাট দীর্ঘদিন ধরে কেসিসি’র মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বিগত সরকারের প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে ও জোরপূর্বক দখল করে রাজস্ব আদায় করে আসছিল। তার ক্ষমতার প্রভাবের কারণে আমরা সব সময় শংকিত ছিলাম। সে জন্য বিগত ১৫ বছরে রূপসা ঘাটটি বিআইডব্লিউটিএ’র নিয়ন্ত্রণাধীন হলেও দখলে নিতে পারিনি। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বিআইডব্লিউটিএ’র উপ-পরিচালক (ইজারা) মো. গোলাম কিবরিয়ার প্রেরিত দপ্তারাদেশ পেয়ে রূপসা ফেরীঘাট, জেলখানা ফেরীঘাট, কালীবাড়ী ফেরীঘাট এবং মহেশ্বরপাশা-দৌলতপুর ফেরীঘাট স্পট কোটেশনের মাধ্যমে নিয়মানুযায়ী ঘাটের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। রূপসা ঘাটটি কেসিসি অবৈধভাবে দখল করেছিলো। আমরা সেটি পুনঃরুদ্ধার করেছি। ইজারাদার নিয়োগে অনিয়ম-র্দূনীতির বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
কেসিসি’র প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা সানজিদা বেগম ভোরের আকাশকে জানান, স্থাণীয় সরকার, পানি সম্পদ ও নৌ-পরিবহন এবং সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ত্রিপক্ষীয় সরেজমিন পরিদর্শন ও সমঝোতা বৈঠকের মাধ্যমে ২০০৯ সাল থেকে রূপসা ফেরীঘাট ও সংলগ্ন এলাকা কেসিসি’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে কেসিসি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টোল আদায় করে আসছে। যার অর্ধেক কেসিসি এবং বাকী অর্ধেক রূপসা উপজেলা প্রশাসন জনকল্যানে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিআইডব্লিউটিএ অবৈধভাবে, অনিয়ম ও নীতি বহির্ভূতভাবে ইজারাদার নিয়োগ করে রূপসা ঘাট দখল করেছে। কেসিসি দখলদার উচ্ছেদ ও কর্মচারীদের উপর হামলা এবং ভাংচুর ও লুটপাটের বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য