পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনাময় উপজেলা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড। সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, ঝর্ণা আর কৃত্রিম লেকের অপরূপ মেলবন্ধন সীতাকুণ্ডের অর্থনীতি বদলে দিতে সক্ষম এ পর্যটন শিল্প। দেশে প্রতিনিয়ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইকো-ট্যুরিজম। যার অন্যতম উপাদান পাহাড়-পর্বত, অরণ্য, সমুদ্র সৈকত, নদী-নালা, জীব বৈচিত্র্য, বৃক্ষ-বনানী, প্রাণীকূল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি-বিনোদন ও জনসাধারণের বৈচিত্র্যময় জীবন-যাপনের পদ্ধতি। যার সব কিছুই বিদ্যমান রয়েছে সীতাকুণ্ডে।
ছোট দারোগারহাটে সহস্রধারা-সুপ্তধারা আর পন্থিছিলার মায়াবী ঝরঝরি ঝর্ণা, গুলিয়াখালী, বাঁশবাড়ীয়া ও আকিলপুর সমুদ্র সৈকত, বোটানিক্যাল গার্ডেন-ইকোপার্ক, ভাটিয়ারী কৃত্রিম লেক আর ভ্রমণপ্রেমীদের আগ্রহের তালিকার নতুন করে যোগ হয়েছে ফৌজদারহাট লিঙ্করোডের ডিসি পার্কের মতো বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় স্পটে সজ্জিত এ উপজেলা। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে ১২ শত ফুট উঁচু পাহাড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আর বার আউলিয়ার পূর্ণভূমি উপজেলাকে করেছে সম্মৃদ্ধ। প্রাকৃতিক বৈরী পরিবেশের ধাক্কা সামলিয়ে বরাবরই উপজেলার পর্যটন স্পটগুলো নিজেদের রাঙ্গাতে শুরু করে আপন সাজে। পরিবেশ-জলবায়ুর পরিবর্তনে নতুন করে আবারো প্রাণচাঞ্চল্যতায় ফিরে আসতে অভ্যস্ত উপজেলার আকর্ষণীয় স্পটগুলো। গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন স্পটগুলোর অবস্থানসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিবরণীতে উপজেলায় প্রতিনিয়ত ভিড় করছে ভ্রমণপ্রেমী দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। বর্ষামৌসুমে কৃত্রিম লেক ও ঝর্ণাগুলোর সৌন্দর্যের সাথে বহুগুণ বেড়ে যায় পর্যটকের সংখ্যা। বাড়তে থাকে হোটেল-রেস্তোরাঁয় জমজমাট ব্যবসা আর পর্যটনমূখী সড়কগুলোর ব্যস্ততা। সীতাকুণ্ডে পর্যটন শিল্প‘কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কতিপয় পেশাজীবি ও কতেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান। আবার পর্যটন দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক খাতও বটে। বিশ্বের অনেক দেশের প্রধান বা উল্লেখযোগ্য আয় আসে পর্যটন খাত থেকে। সিঙ্গাপুর জাতীয় আয়ের ৭৫%, তাইওয়ান ৬৫%, হংকং ৫৫%, ফিলিপাইন ৫০% এবং থাইল্যান্ডের ৩০% জাতীয় আয় আসে পর্যটন খাত থেকে।
এছাড়াও মালদ্বীপ ও মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃত্তির একটি উল্লেখযোগ্য আয় আসে পর্যটন খাত থেকে। বিশ্বের অন্যান্য পর্যটন সম্ভাবনাময় দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবছর ২৭ সেপ্টেম্বর পালিত হয় বিশ্ব পর্যটন দিবস। সীতাকুণ্ডে পর্যটন শিল্প বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও সরকারি কার্যকর পদক্ষেপের কারণে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে। অথচ অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত সীতাকুণ্ড পর্যটন শিল্পে খুবই সম্ভাবনাময় একটি উপজেলা।
সম্প্রতি সহস্রধারা-সুপ্তধারা ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্যের স্বাক্ষী স্থানীয় বাসিন্দা ডা. কমল কদর, নাটক ও চ্চলচিত্র অভিনেতা মো. সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া, সংস্কৃতিকর্মী মো. গোলাম সাদেক ও চট্টগ্রাম জজ আদালতের আইনজীবি মো. খাইরুল বশর পারভেজ বলেন, সীতাকুণ্ডের পর্যটন স্পটগুলো খুবই মনোরম। দৃষ্টিনন্দন স্পটগুলোর সৌন্দর্যে আগত পর্যটকদের অনেকেই স্মার্টফোনে নিজেদের স্মৃতি ধরে রাখার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারে না। উপজেলার বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্পট ঘুরতে এসে গত কয়েক বছরে কতেক মৃত্যুসহ অসংখ্য পর্যটক গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও থামছে না পর্যটকদের গাইড লাইন না নেওয়া বা সাঁতার না জেনে ঝর্ণা কিংবা কৃত্রিম লেকে অসতর্কভাবে নেমে পড়ার প্রচেষ্ঠা। অতি উৎসাহী কিশোর-তরুণ পর্যটকদের মধ্যে নির্দেশনা মানার প্রবণতা খুবই কম। মূলত তরুণ-কিশোর পর্যটকরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন বেশি।
সহস্রধারা ও সুপ্তধারায় গিয়ে দেখা যায় ৩০-৪০ জন তরুণ কিশোর পর্যটকের অবস্থান। সেখানেও দেখা যায় পর্যটকেরা কোন প্রকার সতর্কতা না মেনে ঝর্ণার উপরে নিজেদের ছবি তুলতে অহেতুক ব্যস্ততা কিংবা পাশের বিপজ্জনক ঢালুতে শুয়ে থাকার দৃশ্য। এদিকে পর্যটকেরা উপজেলার দর্শনীয় স্পটগুলো দেখতে গেলেও প্রবেশ পথ থেকে কোথাও সতর্কতামূলক তেমন কোনো দিক নির্দেশনা নেই।
ইজারাদাররা জানান, ঝুঁঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে মৌখিকভাবে বিষয়টি পর্যটকদের নিয়মিত জানানো হয়। অথচ অতি উৎসাহী পর্যটকদের সেদিকে কোন নজর নেই। সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম দুলাল বলেন, পর্যটকদের অনেকেই অতি উৎসাহী হয়ে বিপজ্জনক ঢালুতে চলাচল, গাইড লাইন না মেনে, সাঁতার না জেনে ঝর্ণা কিংবা কৃত্রিম লেকে অসতর্কভাবে নেমে পড়ার প্রচেষ্ঠায় দেখা দেয় দুর্ঘটনা। পর্যটকেরা সচেতন হলে দুর্ঘটনা অনেকটা এড়ানো যেতো।
এদিকে দুর্ঘটনা ঘটলেও উপজেলায় নেই কোন ডুবুরী টিম। দুর্ঘটনা মোকাবেলায় একটি ডুবুরী টিমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন পিপিএম বলেন, সড়ক পথে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ি আঁকা-বাকা আর ঢালু পথ অতিক্রম করে পর্যটকরা অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় সমুদ্র সৈকত, ঝর্ণা কিংবা লেকের পানিতে সাঁতার কেটে গন্তব্যে ফিরতে হয়তো ব্যর্থ হয়ে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে.এম রফিকুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, পাহাড়, ঝর্ণা, সমুদ্র সৈকত, আর কৃত্রিম লেকের অপরূপ মেলবন্ধন সীতাকুণ্ড উপজেলা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর সীতাকুণ্ডে আগত পর্যটকরা আকর্ষণীয় স্পটগুলো পরিদর্শন শেষে নিরাপদে নিজেদের গন্তব্যে ফিরে যায়। প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আবাসিক সুবিধা থাকায় সীতাকুণ্ডের পর্যটন স্পটগুলোতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অগণিত পর্যটকের আগমণ।
তিনি আরো বলেন পর্যটন শিল্পে বদলে দিতে পারে সীতাকুণ্ডের অর্থনীতি।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য