-->
রংপুরে ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি

কুড়িগ্রামে দুদিনে শতাধিক বাড়ি-স্থাপনা নদীতে বিলীন

রংপুর ব্যুরো ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
কুড়িগ্রামে দুদিনে শতাধিক বাড়ি-স্থাপনা নদীতে বিলীন

টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, করতোয়া, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদ-নদী পানি বেড়েছে; সেই সঙ্গে বেড়েছে নদী ভাঙন। এতে অনেক মানুষ জায়গা-জমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। কুড়িগ্রামে গত দুদিনে শতাধিক বাড়ি ও স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। রংপুরের কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়ার চরাঞ্চলে শাক-সবজির ক্ষেত প্লাবিত হয়ে গেছে। ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন স্থানীয়রা।

গত দুই দিনে ধরলা নদীর পানি বেড়ে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের আক্কেল মামুদ কমিউনিটি ক্লিনিক, কুদের কুটি কাশেম বাজার জামে মসজিদ, ৬০টি বসতবাড়িসহ শতাধিক ফসলি জমি, গাছপালা নদীতে বিলীন হয়েছে বলে জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া খুদের কুটি আব্দুল হামিদ উচ্চ বিদ্যালয়, বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। অব্যাহত ভাঙন ঠেকাতে দিন-রাত গাছের গুঁড়ি-ডাল ও বালুর বস্তা ফেলে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন নদীপাড়ের মানুষজন।

বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ধরলার ভাঙনে আমার বাড়িসহ ৬০টি বসতবাড়ি কমিউনিটি ক্লিনিক বিলীন হয়ে গেছে। দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে স্কুল, বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রসহ সব কিছু নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। ভাঙনকবলিত বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের আকতার হোসেন, মোক্তার হোসেন, মহুবর রহমান, ইব্রাহীম আলী জানান, তাদের বসতবাড়ি ও জমাজমি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙন রোধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

উলিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, আক্কেল মামুদ কমিউনিটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে উপকরণসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ধরলার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেখানে লোক পাঠানো হয়েছে। ভাঙন রোধে এক হাজার ৫০০ জিও ব্যাগ ফেলানোর কাজ শুরু হয়েছে। ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও তিস্তার পানি বিপদসীমা উপচে নদী তীরবর্তী চরাঞ্চল ঢুকে পড়েছে। বন্যার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙনের আশঙ্কা। নির্ঘুম রাত কাটছে গঙ্গচড়াও কাউনিয়া উপজেলার নদীর তীরবর্তী মানুষের।

পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠতি আমন ধান ও শীতকালীন শাক-সবজির ক্ষেতসহ পানিতে ডুবেছে বিভিন্ন ফসলি জমি। চরম ভোগান্তিতে পড়েছে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি রেলপথেও। রংপুর অঞ্চলের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার নদ-নদীর কূলঘেঁষা চর ও চরাঞ্চলের কয়েক লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, রোববার রাত ৯টার দিকে রংপুরে তিস্তা নদীর গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ২৯ দশমিক ৫৮ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার) বিপদসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে একই পয়েন্টে সন্ধ্যা ৬টায় পানির প্রবাহ বিপদসীমার ৩১ এবং বিকেল ৩টায় বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানিপ্রবাহিত হয়েছে। এ দিন দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টে সন্ধ্যা ৬টায় পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯৫ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার) বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে হয়। বিকেল ৩টায় একই পয়েন্টে পানির প্রবাহ বিপদসীমার ৮, দুপুর ১২টায় বিপদসীমার ৩, সকাল ৯টায় বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ এবং সোমবার সকাল ৬টায় বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গত ১২ ঘণ্টায় উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি।

জানা গেছে, তিস্তা নদীবেষ্টিত গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী, কোলকোন্দ, গজঘণ্টা, আলমবিদির, নোহালী, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, মধুপুর, হারাগাছ, ঢুসমারা, শহীদবাগের গান্নার চর, পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ও পাওটানার প্রায় ৫০টি গ্রামের ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার বিভিন্ন জায়গায় গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। বন্যার আতঙ্কে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের মানুষের নির্ঘুম রাত কেটেছে। এমন আকস্মিক বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়ছে বানভাসিরা। এই নিয়ে অষ্টমবারের মতো বন্যার কবলে পড়ল তিস্তাপাড়ের মানুষ। তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে রোববার সকাল থেকেই বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ উপজেলায় টানা বৃষ্টি আর উজানের ঢলে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে তিস্তা। পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠতি আমন ধান ও বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ডুবে আছে বন্যার পানিতে। দীর্ঘ সময় ডুবে থাকলে এসব ফসলের মারাত্মক ক্ষতির শঙ্কা করছেন চাষিরা। একই সঙ্গে বন্যার পানিতে ভেসে গেছে বেশ কিছু পুকুরে মাছ। উপজেলার বালাপাড়া ও টেপামধুপুর ইউনিয়নের হরিচরণ শর্মা, আজমখাঁ, হয়রত খাঁ, বিশ্বনাথের চর, চরগনাই, ঢুষমারা, চর রাজিব, গোপিঙ্গা, গদাই,পাঞ্জরভাঙ্গা, তালুক শাহবাজপুরসহ চরাঞ্চলে অস্থায়ীভাবে পানিবন্দি হয়েছে কিছু পরিবার।

গদাই গ্রামের রবিউল ইসলাম বাদল জানান, নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে আমরা ভাঙন আতঙ্কে আছি, পানি কমতে শুরু করলেই ভাঙন শুরু হবে। ইতোমধ্যে অনেক বাড়িঘর ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গঙ্গাচড়া উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের চরাঞ্চল ইতোমধ্যে তিস্তার পানি প্রবেশ করে বন্যা দেখা দিয়েছে। এস ইউনিয়নের প্রায় ২৫০ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়েছে। শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে।

গঙ্গাচড়া উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের চরাঞ্চল ইতোমধ্যে তিস্তার পানি প্রবেশ করে বন্যা দেখা দিয়েছে। টেপামধুপুর ইউনিয়নের চরগনাই গ্রামে ১০টি বাড়ি তিস্তা নদীতে বিলীন হয়েছে। ৪টি ইউনিয়নের প্রায় ২৫০ হেক্টর ফসলি জমি তলিয়েছে। শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে।

বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আনসার আলী বলেন, রাতের মধ্যে পানি বেড়েছে। নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে দুর্ভোগ ও ভাঙনের আতঙ্ক রয়েছে। কোথাও কোথাও ধান, বাদাম, শাক-সবজিসহ উঠতি বিভিন্ন ফসল পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিপাকে পরেছে মানুষ। এরপরও নদীপাড়ের মানুষজনকে সাবধানে থাকতে বলা হয়েছে। আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি, কোথাও কোথাও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয় কি না।

উজানের পাহাড়ি ঢল আর কয়েকদিনের টানা ভারি বৃষ্টিতে শনিবার রাত থেকে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত রোববার রাত থেকে পানি কমতে শুরু করলেও নতুন করে নদী ভাঙনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তিস্তা পাড়ের বাসিন্দারা। সেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে রহিম, কাদের আবু বক্করসহ অনেকের কপালেও পড়েছে। তারা জানানএবারও ফসলি চলে যাবে হয়তো নদীর পেটে এই চিন্তায় আছি।

সোমবার সকাল ৯টায় তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহের উচ্চতা রেকর্ড করা হয়েছে ৫১ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ বিপদসীমার দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার (বিপদসীমা-৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার) নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান।

গংগচড়ার কোলকোন্দ ইউনিয়ানের চর এলাকার রহিম উদ্দিন বলছিলেন, শুক্রবার থেকে হঠাৎ উজানের পানি আসতে থাকে। ফলে নদীতে পানি বৃদ্ধি পায়। শনিবার রাত থেকে পানি হু-হু করে বাড়ে। তবে এখন কমতে শুরু করেছে।

ডালিয়া পাউবোর উপ-প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদীন বলেন, উজানের ঢল আর বর্ষণে তিস্তায় পানির প্রবাহ বেড়েছিল। তখন তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেও বর্তমানে কমতে শুরু করেছে। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানিপ্রবাহ হচ্ছে। যা রাতে আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া পানি বাড়ায় তিস্তা সংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে সবসময় মনিটরিং করা হচ্ছে। যাতে রাস্তা ঘাট, ব্রিজ ভেঙে না যায় সেই বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাজ করা হচ্ছে।

 

 

মন্তব্য

Beta version