-->

সুন্দরবনের বাঘ এখন ১২৫

সুনীল দাস, খুলনা প্রতিনিধি
সুন্দরবনের বাঘ এখন ১২৫

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫টিতে। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে ‘সুন্দরবন বাঘ জরিপ-২০২৪’-এর ফলাফল ঘোষণা করে এ তথ্য জানিয়েছেন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছরের জরিপে ১১টি বাঘ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ সময় উপদেষ্টা বলেন, ২০২৩-২০২৪ সালে সুন্দরবনে পরিচালিত বাঘ জরিপে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি পাওয়া যায় এবং প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটার বনে ২ দশমিক ৬৪টি বাঘের ঘনত্ব পাওয়া গেছে। তবে বনবিভাগের র্কমকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালে বাঘ গণনার পর গত ছয় বছরে সরকারের গৃহীত নানা কর্মকাণ্ড বিশেষ করে বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও প্রজননের উদ্দেশে বনের ৫৩.৫২ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে, সেখান থেকে সকল ধরনের বনজসম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ অনেকাংশে সুফল দিয়েছে। এসব পদক্ষেপের জন্য সুন্দরবনে বাঘের আবাসস্থল, খাদ্য ও চলাচল নির্বিঘ্ন হওয়ায় এবং বাঘের জন্য সব ধরনের হুমকি মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থাগ্রহণ করায় বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। আর এ অবস্থা ধরে রাখতে বিগত সময়ের ব্যবস্থাগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং গবেষণাভিত্তিক নতুন র্কাযক্রম গ্রহণ করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (পশ্চিম) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে তৃতীয় পর্যায়ে বাঘ জরিপে সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে শেষ হয়। বাঘ জরিপে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা, খুলনা, চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে চারটি ব্লকে ৬০৫টি গ্রিডে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রতিটি গ্রিডে বাঘের গতিপথ, বিচরণ, অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে সতর্কতার সঙ্গে দুটি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ৬০৫টি গ্রিডে পর্যায়ক্রমে এক হাজার ২১০টি ক্যামেরা মোট ৩১৮ দিন রেখে দেওয়া হয় এবং ৩৬৮টি গ্রিডের ক্যামেরায় বাঘের ছবি পাওয়া যায়। ১০ লাখ ছবি ও ভিডিও থেকে শুধুমাত্র বাঘের ছবি পাওয়া যায় ৭ হাজার ২৯৭টি। এত বিপুল সংখ্যক বাঘের ছবি ইতোপূর্বে পাওয়া যায়নি। ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে স্বয়ংক্রীয়ভাবে বাঘের ছবি তোলার মূল উদ্দেশ্য হলো বাঘের দেহে যে ডোরাকাটা দাগ আছে তা সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা। বাঘের ডোরাকাটা দাগ ও দেহের বিভিন্ন অংশের ছবি বিশ্লেষণ করে একক ও অনন্য বাঘের ছবি শনাক্ত করা হয়। এ ছাড়া সুন্দরবনের খালে সাধারণত সব বাঘ পানি খেতে আসে। এতে খালের পাড়ে বাঘের পায়ের ছাপ পড়ে। বাঘের ধরন অনুযায়ী ওই ছাপ ভিন্ন হয়। এভাবে পায়ের ছাপ দেখেও বাঘের সংখ্যা গোনা যায়। এছাড়া একজন মানুষের আঙুলের ছাপের সঙ্গে আরেকজনের ছাপের যেমন মিল নেই, তেমনি একটি বাঘের ডোরাকাটার সঙ্গে আরেকটি বাঘেরও মিল থাকে না। ক্যামেরায় একেকটি বাঘের শতাধিক ছবিও ওঠে। সেসব ছবি সংগ্রহের পর কম্পিউটারের সফটওয়্যারে প্রতিটি বাঘের আলাদা করে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই জানা যায়, সুন্দরবনে ঠিক কতগুলো বাঘ আছে।

বাঘ সংরক্ষণে সরকারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাঘসহ সুন্দরবনের অন্যান্য বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও প্রজননের উদ্দেশে বনের ৫৩.৫২ শতাংশ এলাকাকে রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে, সেখান থেকে সকল ধরনের বনজসম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও সুন্দরবনের বাঘ লোকালয়ে আসা ঠেকাতে এবং বাঘে-মানুষের চিরায়ত দ্বন্দ্ব প্রতিরোধে সুন্দরবনের ৬০ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের ফেন্সিং দিচ্ছে বন বিভাগ। সুন্দরবনের দুই বিভাগের চার পয়েন্টে বাগেরহাট অংশের ধানসাগর, শরণখোলা এবং খুলনা অংশের কৈখালী ও কৈলাশগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় প্রায় ৪০ কিলোমিটার ফেন্সিং সম্পন্ন হয়েছে। আরও ২০ কিলোমিটার এলাকায় ফেন্সিং দেয়ার কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই বনের যে অংশে নাইলন ফেন্সিং দেয়া হয়েছে সেখানে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অংশে নাইলনের ফেন্সিং বা নেট দিয়ে সেখানকার বনবিভাগ সুফল পাওয়ায় আমাদের সুন্দরবন অংশেও সুফল মিলবে। একই সঙ্গে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আশ্রয়ের জন্য বনের ভিতরে ১২টি মাটির উঁচু কিল্লা ও ডিবি নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক আবু নাসের মহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। এছাড়া শুকর, বানর এমনকি মাঝে-মধ্যে কাঁকড়াও বাঘ খেয়ে থাকে। বাঘের চাহিদা মোতাবেক খাদ্যের সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যার ফলে সুন্দরবনের বাঘ এখন আর রোকালয়ে তেমন আসছে না এবং মৃত্যুর শিকার হচ্ছে না। এছাড়াও প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেন্সপন্স টিমের ৩৪০ সদস্য এবং ৪টি রেঞ্জের কমিউনিটি পেট্রল গ্রুপের ১৮৫ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যারা বাঘ সুরক্ষায় কাজ করছে। সরকারের এসব নানামুখী উদ্যোগের ফলে সুন্দরবনে বাঘের নিরাপদ আবাস গড়ে ওঠায় জরিপে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলেও মনে করেন এই র্কমকর্তা।

খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, বনের ৫৩.৫২ শতাংশ এলাকাকে রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে, সেখান থেকে সকল ধরনের বনজসম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা এবং সুন্দরবনের বাঘ লোকালয়ে আসা ঠেকাতে এবং বাঘে-মানুষের চিরায়ত দ্বন্দ্ব প্রতিরোধে সুন্দরবনের ৬০কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের ফেন্সিংসহ একাধিক পদক্ষেপের ফলে বাগের সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে হয়। তিনি বলেন, এছাড়া জরিপের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের পর ভারত, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের মতামত গ্রহণ করা হয়। সার্বিক বিচার বিশ্লেষণে ২০২৩-২০২৪ সালে সুন্দরবনে পরিচালিত বাঘ জরিপে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি পাওয়া যায় এবং প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটার বনে বাঘের ঘনত্ব পাওয়া যায় ২ দশমিক ৬৪। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৫ সালের তুলনায় বাঘের সংখ্যা ১৭ দশমিক ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এছাড়া দেশের বাঘের সংখ্যা নিয়ে আরেকটি ইতিবাচক দিক ফুটে উঠেছে। ২০২৩-২৪ সালের বাঘজরিপে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঘ শাবকের ছবি পাওয়া যায়। তবে বাঘ শাবকের সংখ্যা জরিপের ফলাফলে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। কারণ ছোট থেকে পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বাঘ শাবকের মৃত্যুর হার অনেক বেশি হয়ে থাকে। ২০১৫ ও ২০১৮ সালের বাঘ জরিপে যেখানে মাত্র ৫টি করে বাঘ শাবকের ছবি পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে ২০২৩-২৪ সালের বাঘজরিপে ২১টি বাঘ শাবকের ছবি পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা ভবিষ্যতে বাঘ আরও বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version