-->

কটিয়াদীতে ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট শুরু

মিয়া মোহাম্মদ ছিদ্দিক, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
কটিয়াদীতে ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট শুরু
প্রতিবছরের ন্যায় পূজা উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার থেকে এ ঢাকের হাট শুরু হয়েছে

চারদিকে ঢাক ঢোল, কাঁসর, সানাই, নানা বাঁশি, করতাল ও খঞ্জরির আওয়াজে প্রকম্পিত এলাকা। কারো হাতে ঢোল বাঁশিসহ নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র। বাজারের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাজনা বাজিয়ে নেচে গেয়ে পূজারিদের মন আকৃষ্ট করছে। এমন দৃশ্য কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলায় পৌর এলাকায় প্রেসক্লাব সংলগ্ন পুরাতন বাজারে। প্রতিবছর পূজা শুরুর আগের দু’দিন এই হাট বসে। মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলবে বুধবার পর্যন্ত।

যুগ যুগ ধরে অম্লান হয়ে আছে এই ঢাকের হাটের ঐতিহ্য। দূরদূরান্ত থেকে পূজারিরা এই হাটে আসেন পছন্দের বাদকদলটি বাছাই করে নিয়ে যেতে। তাদের আকৃষ্ট করতে নানা রকম ছন্দে ঢাক ঢোল, বাঁশি বাজিয়ে তাদের মুনশিয়ানা দেখায়। বাজনা পছন্দ হলেই শুরু হয় বায়না করার আলাপ আলোচনা। কোন দলের কত মূল্য হবে, তা নির্ধারিত হয় উপস্থিত পরীক্ষার মাধ্যমে। বাজনার তালে নাচ আর নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে পূজারিদের নজর কাড়ারও চেষ্টা করেন ঢাকিরা। বাজনার শব্দে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। যাদের সঙ্গে দরদাম মিলছে, তাদের অনুসরণ করে পিছু নেন ঢাকিরা।

এই হাটে ঢাক ঢোল বিক্রি হয় না। পূজায় চুক্তিভুক্ত হয়ে দলটি পূজারির বাড়িতে যায়। কেউ আগে থেকেই চুক্তিভুক্ত থাকায় হাটে আসার প্রয়োজন হয় না। মুঠোফোনে কথা বলে চলে যায় গন্তব্যে। এক সময় শত শত বাদক দল আসলেও এখন ৬০-৮০টি দল আসে। প্রতি দলে ১৫-২০ জন বাদক থাকে। বর্তমানে এর সংখ্যা কম আসার মূল কারণ প্রযুক্তির ব্যবহার। হাটে আসা ছাড়াই চুক্তি হয়ে চলে যান।

কটিয়াদীর এই ঢাকের হাটের ইতিহাস ৪০০ বছরের বেশি সময়ের পুরোনো। এ কারণে হাটটি জেলার সব ধর্মের মানুষের কাছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে। হাট বসে দুর্গাপূজা ঘিরে। পঞ্চমী ও ষষ্ঠী হাটবার। এবারও একই নিয়ম মেনে পুরানবাজারে বসেছে ঢাকের হাট।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাজারের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাজনা বাজাচ্ছেন তারা। কেউ রিকশা থেকে দল-বল নিয়ে সবেমাত্র নামছেন। কেউ আগের রাতেই এসেছেন। কেউ চুক্তি হয়ে যাওয়াতে চলে যাচ্ছেন। অনেক দল বায়না না হওয়া পর্যন্ত হাটে অবস্থান করবেন। এবার হাটে দুই শতাধিক ঢাকি এসেছে বলে আয়োজকরা জানান। স্থানীয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক পূজারিরা এসেছেন পছন্দের বাদক দলটি নিতে। ৩০-৪০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকায় চুক্তি হয়ে অনেক দল চলে গেছে।

ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জ থেকে আগত বরুণ দাস বলেন, আমার দলে ছয় সদস্যের ঢাকি। একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে একসঙ্গে আমরা চল্লিশ জন আসছি। বায়না হলে বিভিন্ন পূজামণ্ডবে চলে যাবো।

নরসিংদীর বেলাবো থেকে আসা নিতাম বলেন, এবার স্থানীয়ভাবে চুক্তি হয়নি, তাই কটিয়াদীর ঢাকের হাটে আসলাম। পাঁচ সদস্যের দল আমাদের। ত্রিশ হাজার চাচ্ছি। বিশ হাজার বায়না বলা হচ্ছে। আরেকটু দেখে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যাবো।

কটিয়াদী উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ধ্রুব রঞ্জন দাস বলেন, এই ঢাকের হাট আমাদের ঐতিহ্য। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ঢাকিদের দেখাশোনা ও তদারকি করছি। হাটে অস্থায়ী মনিটরিং কেন্দ্র স্থাপন রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে সার্বিক নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। এলাকাবাসী সবাই সহযোগিতা করছে।’

জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন এবং পুরস্কৃত করেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু। পরবর্তী সময়ে হাট স্থানান্তরিত হয় পুরানবাজারে। এখনো হাট বসে সেখানে।

কটিয়াদী মডেল থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ঢাকিদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ কাজ করছে। শান্তিপূর্ণ ও আনন্দঘন পরিবেশে হাট চলছে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version