সাদা মনের মানুষ পাওয়া খুব কঠিন, অধিকাংশ মানুষের মনে থাকে কুটিলতা, জটিলতা ও কালীমাপূর্ণ। উপরের চাকচিক্যময় সব কিছু সহজ মনে হলেও মন বোঝা সহজ নয়, আর মন দেখা সে তো আরও অনেক কঠিন কাজ। যারা সাদা মনের মানুষ, তাঁরা সব সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চান কাজের অন্তরালে। তাঁরা আসল নাম প্রকাশ করতে চান না। মানুষের সম্মুখেও নিজেকে প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন। তাঁরা যা কিছু করেন সব গোপনে, অন্তরালে।
গোপনে মানুষের উপকার করে নিজের আত্মতৃপ্তিই তাঁর মূল বিষয়। সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য তাঁদের কাছ থেকে শেখা যায়, আর সেটা হলো ‘মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- স্রষ্টার আনুগত্য করে সৃষ্টির সেবা করা’। তাঁর কাছে যে কোন সেবাই মহৎ।
শেরে বাংলা আবুল কাশেম (এ.কে.) ফজলুল হক তেমনই একটি অবিস্মরণীয় নাম, এক অসাধারণ ব্যক্তি। মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে শেরে বাংলা আমাদের কাছে চিরস্মরণীয়। জাতি হিসেবে আমরা যে সবাই বাঙালি-এই ঐতিহাসিক সত্যের মূল ভিত্তি তিনিই রচনা করেছেন। বিপুল ঐশ্বর্যশালী পিতার একমাত্র সন্তান হলেও ফজলুল হক বাল্যকাল থেকেই বহু সদগুণের অধিকারী ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তেজস্বিতা, তীক্ষ্ম মেধা ও প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। তেমনি শৃঙ্খলা ও আদর্শের প্রতি অনুরক্ত করেই গড়ে তোলা হয়েছিল তাঁকে।
শেরে বাংলা ছিলেন উপমহাদেশের এক অসাধারণ প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতা। প্রায় অর্ধ-শতাব্দীর অধিককাল তিনি গণমানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার জন্য তিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। শের-এ-বাংলা এদেশের সাধারণ মানুষের জন্যে যা করেছেন, অন্য কোন জনদরদী নেতার পক্ষে এ যাবৎ তা করা সম্ভব হয়নি। এদেশের মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্যে তিনিই সর্বপ্রথম অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।
এ.কে. ফজলুক হকের পূর্বপুরুষ আঠারো শতকে ভারতের ভাগলপুর হতে পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার বিলবিলাস গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এ বংশের কাজী মুর্তজা একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তার পুত্র কাজী মুহম্মদ আমিন। কাজী মুহম্মদ আমিনের পুত্র মুহম্মদ আকরাম আলী বরিশাল কোর্টে আইন ব্যবসা করতেন। তার দুই পুত্র কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ, কাজী আবদুল কাদের ও পাঁচ কন্যা। কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদের একমাত্র পুত্র ছিলেন এ. কে. ফজলুক হক। কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ ১৮৪৩ সালে চাখারে জন্ম গ্রহণ করেন এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ালেখা করেন। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ গ্রাজুয়েট ছিলেন। ১৮৭১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি বি.এল. পাশ করে আইন ব্যবসা শুরু করেন। মুহম্মদ ওয়াজেদ রাজাপুর থানার সাতুরিয়া মিয়া বাড়ির আহমদ আলী মিয়ার কন্যা বেগম সৈয়দুন্নেছাকে (শেরে বাংলার মা) বিয়ে করেন।
শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার বানরীপাড়া থানার চাখার গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের বাল্যকাল থেকেই তেজস্বিতা, তীক্ষ্ণ মেধা ও প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। ঘরেই তাঁর আরবী, ফারসি ও উর্দু শিক্ষা শুরু হয়। ১৪ বছর বয়সে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে প্রথম শ্রেণীর বৃত্তি এবং পরিতোষিকসহ ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এফ. এ এবং পরে রসায়ন বিদ্যা, পদার্থ বিদ্যা ও গণিতে অনার্সসহ বি. এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৫ সালে অঙ্কে এম. এ. পাস করেন। বরিশালের রামচন্দ্র কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনার পর ১৮৯৭ সালে তিনি বি. এল. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তিনি এম.এ. পাশ করার পর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেন। এ সময় নবাব আবদুল লতিফ এর পৌত্রী খুরশিদ তালাত বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। খুরশিদ তালাত বেগম দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। খুরশিদ তালাত বেগমের অকাল মৃত্যুর পর তিনি হুগলী জেলার অধিবাসী এবং কলকাতা অবস্থানকারী ইবনে আহমদের কন্যা জিনাতুন্নেসা বেগমকে বিয়ে করেন। কিন্তু, জিনাতুন্নেসাও নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করেন এবং ১৯৪৩ সালে এ. কে. ফজলুক হক মীরাটের এক ভদ্র মহিলাকে পত্নীত্বে বরণ করেন। তাদের সন্তান এ. কে. ফাইজুল হক ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পাট প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
কর্মজীবনে তিনি পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা আইনজীবী স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহকারী রূপে ১৯০০ সালে কলকাতা হাই কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৬ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্টেটের চাকরি গ্রহণ করেন। কিন্তু তেজস্বী হক সাহেব সরকারের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯১১ সালে চাকরি ছেড়ে আবার আইন ব্যবসায়ে নেমে পড়েন। ১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত নিখিন ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে তিনি অংশ নেন। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন। ১৯২০ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত মন্টেগু-চেমসফোর্ট কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ শহরে লীগ কংগ্রেসের যুক্ত অধিবেশনে তিনি যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন, তাই বিখ্যাত ‘লক্ষ্ণৌ চুক্তি’ নামে অভিহিত হয়।
শেরে বাংলা বহু প্রতিভার অধিকারী হলেও মনে প্রাণে ছিলেন বাঙালি রাজনীতিবিদ। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট শেরে বাংলা হক সাহেব নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি বহু রাজনৈতিক অনেক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার মধ্যে কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭ – ১৯৪৩), পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (১৯৫৫), পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৫৬ – ১৯৫৮) অন্যতম।
ব্যক্তিগত দানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন হাতেম তাই। তার গোপন দানে কত দুঃস্থ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, কত ছাত্র পরীক্ষার ফি দিয়ে নিশ্চিন্তে পরীক্ষা দিয়েছে, তার দানে যে কত সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কত পীড়িতের দুঃখমোচন হয়েছে তার হিসেব নেই। তিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন একজন সাদা মনের মানুষ। কৃষকপ্রজা আন্দোলন, বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ও ঋণ সালিশী বোর্ড প্রবর্তনের জন্যে তিনি বাংলার দারিদ্র্য-নিপীড়িত কৃষক সমাজের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। বরিশালে জন্মগ্রহণ করে এ ভূমিকে করেছেন ধন্য, জাতিকে করেছেন গর্বিত।
সাদা মনের মানুষ জীবন পাল্টে দিবে, যার স্বার্থই শুধু- আত্মতৃপ্তি, সে দিতে জানবে, নিতে জানবে না। মানবতাই তার ধ্যান জ্ঞান, মানুষের মুক্তিই তার পেশা, পরোপকারীতাই তার নেশা। যিনি গোপনে মানুষের সেবা করে যান কোন প্রতিদানের আশা ছাড়াই। তাঁর জীবন গবেষণা করে আমরা যা পাই- কোন অহংকারের লেশ মাত্রও তাঁর মধ্যে ছিল না। ছিল না কোন বাড়াবাড়িই ছিটেফোটা, ধর্ম আর্চনায় তাঁর কোন কমতি ছিল না, স্ত্রী ভক্তিতেও তাঁর জুড়ি মেলানো ভার ছিল। তিনি বাঙালি মুসলমানদেরকে অকাতরে শুধুই দিয়ে গেছেন, নিয়ে গেছেন মহত্ব, হাজারও মানুষের সিক্ত ভালবাসা।
বাঙালি জাতির গৌরব উজ্জ্বল নক্ষত্র শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। তার মহতি কর্ম ও অবদানের কারণে, তিনি বাংলার কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন। শিক্ষার প্রকৃত আলো জ্বেলে ও প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে ফুটিয়ে ছিলেন উজ্জ্বল হাসি। বিশেষ করে বাংলার মুসলমান যখন অশিক্ষা, দারিদ্র ও হতাশায় ভুগছে তখন তিনিই নিরলস প্রয়াস চালিয়ে এই অধঃপতিত জাতিকে উদ্ধার করেন। তাঁর কর্মময় জীবনে তিনি শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
এ কে ফজলুল হক তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথমেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যতীত দরিদ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের অবস্থার উন্নতির কোন আশা নেই। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ছিল তখন প্রজাদের উৎপীড়ন ও নিপীড়নের একটি হাতিয়ার বিশেষ। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ১৯৩৭ সালে এই আইনের আমূল সংশোধন করলেন। আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে এতদিন জমিতে প্রজার যে স্বত্ব অস্বীকৃত হয়ে আসছিল, তিনি আর স্বীকৃতি দিলেন।
এ দেশের রাজনীতিতে তিনি প্রথম উচ্চারণ করেন ‘লাঙ্গল যার জমি তার’। নিজের রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘বাংলার সাধারণ মানুষকে আমি ভালবেসেছি, এ আমার অপরাধ। সবই করেছি আমার বাংলার শোষিত, অত্যাচারিত, নিগৃহীত, লাঞ্ছিত মানুষের ব্যথাতুর মুখের দিকে চেয়ে। আমি তাদের কোনদিন রাজপ্রাসাদের স্বপ্ন দেখাইনি বা পরলোকের বেহেশত বানাতে চাইনি। বাংলার নরম পলিমাটির সাধারণ মানুষকে চিরদিন নিশ্চিন্তে নিজস্ব কুঁড়েঘরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মেহনতের বদৌলতে দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভারতের সংস্থান করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, আমার রাজনীতি এই ডাল-ভাতের রাজনীতি। তাই লাঙ্গল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার- এই দৃঢ় শপথ নিয়ে আমি দেশ সেবায় ব্রত হয়েছি।’
ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সাধনা ছিল তাঁর আজীবনের। তাঁরই প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তাঁর স্বগ্রাম চাখারে ফজলুল হক কলেজ এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ১৯৪০ সালে তার প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছরে তার প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুন্সিগঞ্জে প্রতিষ্ঠা হয় হরগঙ্গা কলেজ। তাঁর নিজ গ্রাম চাখারে কলেজের পাশাপাশি মাদ্রাসা ও হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তপসিলী সম্প্রদায়ের শিক্ষার জন্য তিনি প্রথম বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন। ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে কলকাতায় লেডি ব্রার্বোন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি মুসলমানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন। শিক্ষা বিস্তারে শেরে বাংলার ভূমিকা ছিল অনন্য। বাঙালি মুসলমানদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারে ছিল তার অসামান্য অবদান। শিক্ষা প্রসারের জন্য তার অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
১৯৩৭ সালে শের-এ-বাংলা অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৪০ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে জ্বালাময়ী বক্তৃতায় প্রথম পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন। তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে পাঞ্জাববাসীরা তাঁকে শের-ই-বঙ্গাল অর্থাৎ বাংলার বাঘ উপাধি দেয়। সে থেকে তিনি শের-ই-বাংলা নামেই পরিচিত। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকালের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে তিনি বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেন। এ সময়ে তিনি ‘ঋণ সালিশী বোর্ড’ গঠন করেন। এর ফলে দরিদ্র চাষীরা সুদখোর মহাজনের কবল থেকে রক্ষা পায়।
১৯১৮ সালে ভারত মুসলিম লীগের দিল্লী অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তার দেওয়া ভাষণ ইতিহাসের এক স্বর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে। ১৯২৫ সালে তিনি বাংলার মন্ত্রী সভার সদস্য মনোনীত হন। ১৯২৭ সালে তিনি কৃষক-প্রজা পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৩০-৩১ এবং ১৯৩১-৩২ সালে তিনি বিলেতে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। সেখানে তার ব্যক্তিত্বপূর্ণ বক্তৃতা সবার মনে সাড়া জাগায়। ১৯৩৫-৩৬ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন এ পদে অধিষ্ঠিত প্রথম বাঙালি মুসলমান। ১৯৩৭ সালে তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৫৪ সালে দেশের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ‘যুক্তফ্রন্ট’ দলের নেতৃত্ব দিয়ে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টর-অব-ল এবং ১৯৫৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাঁকে ‘হিলাল-ই-পাকিস্তান’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
তৎকালীন ফন্দিবাজ কংগ্রেসের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফজলুল হক ছিলেন এক সাহসী কণ্ঠস্বর। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সমস্ত প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস সরকার গঠন করেছিল সে সমস্ত প্রদেশে স্থানীয় কংগ্রেস কমিটি গুলো সমান্তরাল সরকার হিসাবে কাজ করতে থাকে। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশে মুসলমানদের উপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছিল তার বিস্তারিত একটি ফিরিস্তি দিয়ে তৎকালীন বঙ্গদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব একে ফজলুল হক কংগ্রেস নেতা জওহর লাল নেহেরুর কাছে এক সুদীর্ঘ পত্র লেখেন এবং জোর জুলুমের অবসান ঘটানোর জন্য অনুরোধ জানান।
কংগ্রেস মন্ত্রিসভা পদত্যাগের পরপরই বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক এক বিবৃতিতে বলেন : ‘‘ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার উদ্দেশ্য কংগ্রেস মারমুখো হিন্দুদেরকে চরম ঔদ্ধত প্রদর্শনের জন মাঠে নামিয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর কংগ্রেস তার ইচ্ছা ও সংকল্প চাপিয়ে দেয়ার জন্য এ কাজ শুরু করেছে।’’ একে ফজলুল হক ‘কংগ্রেস শাসনে মুসলমানদের দুর্ভোগ’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রণয়ন করে কংগ্রেসী অত্যাচারের পরিমাপ লিপিবদ্ধ করেন।
বাংলার নয়নমণি শের-এ-বাংলা ফজলুল হক ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল প্রায় ৮৯ বছর বয়সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। এ প্রবীণ জনদরদী নেতার মৃত্যু সংবাদ প্রচারের সাথে সাথে সারা বাংলায় নেমে আসে শোকের ছায়া, শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে সমগ্র দেশবাসী। ঢাকার পুরানো হাইকোর্টের পাশে তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হয়। ফজলুল হক আমাদের মাঝে বেঁচে নেই; কিন্তু বাঙালি সমাজ যত দিন বেঁচে থাকবে, ততদিন তাদের হৃদয়ে ফজলুল হক চিরজীবী।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতি বুঝিনে। ওসব দিয়ে আমি ফজলুল হককে বিচার করিনে। আমি তাঁকে বিচার করি গোঁটা দেশ ও জাতির স্বার্থ দিয়ে। একমাত্র ফজলুল হকই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বাঁচাতে পারে। সে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সাচ্চা মুসলমান। খাঁটি বাঙালিত্ব ও সাচ্চা মুসলমানিত্বের এমন সমন্বয় আমি আর দেখিনি।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য