আট দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়াসহ বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় মহাসমাবেশ এবং ঢাকা অভিমুখে ‘লং মার্চ’করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ মঞ্চ।
শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) বিকেল ৩টায় চট্টগ্রাম নগরীর ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে আয়োজিত সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেন বক্তারা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশব্যাপী মন্দির, হিন্দু বাড়িঘরে হামলা, শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ এবং ৮ দফা দাবি পুরোপুরি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমাবেশের কর্যক্রম।
এদিকে সমাবেশ শুরু আগে থেকে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে বিভিন্ন সনাতনী সংগঠন মিছিল নিয়ে অংশ নেয়। এসময় লালদীঘির মাঠসহ আশপাশের এলাকা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। এছাড়া বিভিন্ন স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে সমাবেশস্থল। নগরের বকশিবিট থেকে শুরু করে কে সি দে রোড, জেল রোড, লালদীঘির চারপাশ ও কোতোয়ালি মোড় পর্যন্ত ছিল লোকে লোকারণ্য। সমাবেশে আসা বিভিন্ন নারী-পুরুষের হাতে ছিল বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ব্যানার–ফেস্টুন।
বক্তারা বলেন, স্বাধীনতার স্বাধীনতার ৫৩ বছরে সনাতনীরা শুধু অবহেলিত ছিল। সরকার আসে সরকার যায়; কিন্তু সনাতনীদের ভাগ্য বদলায় না। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তারা সনাতনীদের দুঃখ দুর্দশাকে লুকানোর চেষ্টা করে। সনাতনীদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়, নির্যাতন লুকিয়ে স্বাভাবিকতার কথা বলে। গত ৫৩ বছরে এদেশে হওয়া হিন্দু নির্যাতন, খুনের কোনো বিচার হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা বারবার এই ধরনের ঘটনায় উৎসাহিত হয়েছে। প্রতিবার ভোট পরবর্তী বা ক্ষমতার পালাবদলের সময় নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে হিন্দুদের ওপর। সেটা কেন হবে? কারা দোষী? কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত? তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হলে তো বেরিয়ে আসবে কারা সাম্প্রদায়িক ঘটনার সঙ্গে জড়িত? কেন সরকার সাম্প্রদায়িক ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করছে না।
বক্তারা আরো বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা ধন্যবাদ দিতে চাই। তারা দুর্গাপূজায় ১ দিন ছুটি বাড়িয়েছে। তবে সেটি পর্যাপ্ত নয়। আমরা চেয়েছি ৫ দিনের ছুটি। সেখানে ২দিন ছুটি কেন? যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এদেশের ছাত্র জনতা প্রাণ দিয়েছে সেখানে আবার বৈষম্য হবে কেন? ক্ষতিগ্রস্ত সনাতনীদের ক্ষতিপূরণ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সংস্কার করার কথা বলেছে সরকার। এটি খুবই ইতিবাচক। খুব দ্রুত এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সরকার যদি ৮ দফা দাবি মেনে নেয় সনাতনীরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।
মুখপাত্র ও পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘যে মঞ্চ থেকে ৬ দফা দাবি ঘোষিত হয়েছে, সেই লালদিঘীর ময়দানে আজ হিন্দু সনাতনীদের গণজোয়ার এসেছে। আমাদের যত বেশি নির্যাতন করা হবে, তত বেশি আমরা এক হবো। এই ঐক্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে বাংলার কৃষ্টি কালচারের ঐক্য। এই ঐক্য কোনোভাবে খণ্ডিত করা যাবে না।'
তিনি বলেন, 'যদি এই দেশ থেকে আমাদের উচ্ছেদ করে কেউ শান্তিতে থাকতে চান, তাহলে এটা আফগানিস্তান-সিরিয়া হবে, গণতান্ত্রিক শক্তি থাকবে না, সাম্প্রদায়িকতার অভয়ারণ্য হবে।’সংখ্যালঘু পরিচয়ে ৯৩ জন হিন্দুকে পুলিশের চাকরি থেকে অব্যাহিত দেয়া হয়েছে। ভেটেরিনারি, চবিতে হিন্দুদের শনাক্ত করা হচ্ছে। যারা রাজনীতি করে না, মানবতার কথা বলছে, তাদেরকে মামলার আসামি করা হচ্ছে।'
পাকিস্তানে ৫৪ সালে আমেরদ ২৮ শতাংশ অনুযায়ী সংসদীয় আসন ছিল ৭০টি। আজকে হিন্দুদের জন্য একটা সংসদীয় আসন নাই। আমাদের বিভিন্ন দলীয় পরিচয়ে নমিনেশন দিয়ে দলীয় চাকরে পরিণত করছে। কিন্তু হিন্দুদের অস্তিত্বের কথা বলতে কোনো অবলেশ দিচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় আমাদের সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদীয় আসন বিন্যাস করতে হবে। প্রয়োজনে ভোট বর্জন করবো। কিন্তু আমরা গণতন্ত্রের নামে প্রহসন মেনে নেব না। বরাদ্দ নিয়ে প্রহসন চলছে। ১৫ হাজার কোটি টাকা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বরাদ্ধের মাত্র ২০০ কোটি মতো তিন ধর্মাবলম্বীদের জন্য?’ তাহলে এটি কী প্রহসন নয়?
তিনি আরো বলেন, এই আন্দোলনকে কোনোভাবেই আমরা হারিয়ে যেত দেব না। আমরা এরপরে রংপুরে, খুলনাতে, বরিশালে এবং প্রতিটি বিভাগীয় শহরে মহাসমাবেশ আমরা ঘোষণা করছি। সেখান থেকে প্রতিটি জেলায় জেলায় সমাবেশ হবে এবং জেলা থেকে উপজেলায় যাব। এরপর আমরা ঢাকামুখী লংমার্চ করব। আমাদের এই আন্দোলন সুশৃঙ্খল আন্দোলন, কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। হিন্দু কিছু বললে রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করে। একটি তথাকথিত পত্রিকায় বলা হচ্ছে এটি ইসকনের সমাবেশ। কিন্তু এটি ইসকনের নয়, সনাতনীদের সমাবেশ। এই সমাবেশে নাকি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ এসেছে এরকম প্রপাগন্ডা করা হয়েছে। এর আগেও চেরাগী নিয়ে একইরকম রিপোর্ট করেছে। কিন্তু সরকারের কোনো এজেন্সির এই নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। আগে আমরা সুঙ্খলভাবে সভা-সমাবেশ করেছি। কিন্তু প্রতিবার রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। হিন্দুদের আওয়ামী লীগের ট্যাগ দেওয়া পরিহার করুন।
সংগঠনের মুখপাত্র ও পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর সভাপতিত্বে এবং স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারীর সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন— শংকর মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ তপনান্দ গিরি মহারাজ, কৈবল্যধামের মোহন্ত মহারাজ কালীপদ ভট্টাচার্য, পটিয়া পাঁচরিয়া তপোবন আশ্রমের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ রবীশ্বরানন্দ পুরী মহারাজ, ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারী, বাঁশখালী ঋষিধামের মোহন্ত সচিদানন্দ পুরী মহারাজ, শ্রীমৎ মুরারী দাস বাবাজী, তপোবন আশ্রমনের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ প্রাঞ্জলানন্দ পুরী মহারাজ।
আট দফা দাবিসমূহ হলো—• সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দোষীদের দ্রুততম সময়ে উপযুক্ত শান্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্তদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।• অনতিবিলম্বে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।• সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে।• হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে হিন্দু ফাউন্ডেশনে উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টিকেও ফাউন্ডেশনে উন্নীত করতে হবে।• ‘দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন’ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।• প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ এবং প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনা রুম বরাদ্দ করতে হবে।• সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড, আধুনিকায়ন করতে হবে।• শারদীয় দুর্গাপজায় ৫ দিন ছুটি দিতে হবে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য