-->

জামালপুর মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টরে ৭১-এ ৪ ডিসেম্বর বিজয় শুরু

জামালপুর প্রতিনিধি
জামালপুর মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টরে ৭১-এ ৪ ডিসেম্বর বিজয় শুরু

জামালপুরের টগবগে তরুণ যুবকরা দেশমাতৃকার টানে ১৯৭১-এ দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত কোচবিহার জেলার মহেন্দ্রগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে একের পর এক যোগ দিতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর সেনানীরা।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসূত্রে জানা গেছে, ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ সর্বপ্রথম ধানুয়া কামালপুর, ৫ ডিসেম্বর বকসিগঞ্জ, ৬ ডিসেম্বর দেওয়ানগঞ্জ, ৭ ডিসেম্বর ইসলামপুর, ৮ ডিসেম্বর মেলান্দহ, ১০ ডিসেম্বর জামালপুর সদর এবং ১২ ডিসেম্বর সরিষাবাড়ি শত্রুমুক্ত হলে জামালপুর জেলায় বিজয় অর্জিত হয়। ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর ধানুয়া কামালপুর ঐতিহাসিক বিজয়ের পর সেদিন বিকালে বকসিগঞ্জ সদরে দ্বিতীয় দফা হানা দেয় মুক্তিযোদ্ধারা।

তাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে ৫ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফা ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে বকসিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। একের পর এক বিজয় অর্জনের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা রাতে মুক্তিযুদ্ধের নাসির কোম্পানির বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দিন-রাত প্রাণপণ লড়াই করে অবশেষে ৬ ডিসেম্বর ভোর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে তৃতীয় দফা শত্রুমুক্ত করেন।

৬ ডিসেম্বর বিকালে মুক্তিযুদ্ধের জালাল কোম্পানি এবং বদি কোম্পানির নেতৃত্বে ইসলামপুর উপজেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেদিন বিকাল থেকে সারা রাত প্রাণপণে লড়াই করে অবশেষে ৭ ডিসেম্বর ভোর রাতে পাক-হানাদারদের পতন ঘটিয়ে চতুর্থ দফা বিজয় লাভ করে ইসলামপুর।

মিত্রবাহিনীর নির্দেশে ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা রাতে মুক্তিযুদ্ধের আলম কোম্পানি ও বদি কোম্পানির নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মেলান্দহ উপজেলায় পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। রাতভর সম্মুখ যুদ্ধে পাক-হানাদারদের পরাজিত করে অবশেষে ৮ ডিসেম্বর ভোর রাতে মেলান্দহ পঞ্চম দফায় শত্রুমুক্ত করেন।

জামালপুর শহরের প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (পিটিআই) ছিল পাকসেনাদের চরম দুর্ভেদ্য শক্তিশালী ঘাঁটি। তাই মুক্তিযুদ্ধের মিত্র বাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার হরদেব সিং ক্লেয়ার-এর নির্দেশে যুদ্ধকালীন আঞ্চলিক অধিনায়ক ইউসুফ আলীর নেতৃত্বে ৮ ডিসেম্বর নাসির কোম্পানি, বদি কোম্পানি, আলম কোম্পানিসহ মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা একত্রিত হয়ে জামালপুর শহরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেদিন মুক্তিযুদ্ধে মৃতঞ্জয়ী খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সি (বীর প্রতীক) নিজের জীবন বাজি রেখে আত্মসমর্পণ পত্র নিয়ে পাকসেনা ক্যাম্প কমান্ডার কর্নেল সুলতান খানের কাছে চিঠি পৌঁছান।

চিঠি পেয়ে পাকসেনা কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ অস্বীকার করে বীর প্রতীক জহুরুল হক মুন্সিকে চোখ বেঁধে অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে রাতে তার শরীরে টাইম বোমা বেঁধে ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলে দেয়। এ খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী এবং মিত্র বাহিনীর সদস্যরা সিংহের মতো গর্জে উঠে তুমুল আক্রমণ শুরু করেন।

পরদিন ভারতীয় বোমারু বিমান এসে পাকসেনা ক্যাম্পে মুহুর্মুহু বোমা বর্ষণ করতে থাকে। অবশেষে ১০ ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনীর ২৩৫ জন সদস্য নিহত হলে ৩৭৬ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে, ফলে জামালপুর সপ্তম দফায় শত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর ১১ জন বীরযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন।

১১ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সরিষাবাড়ি পাক-হানাদার বাহিনীকে ঘিরে আক্রমণ শুরু করে। ফলে ১২ ডিসেম্বর পাক-হানাদারদের সর্বশেষ পরাজিত করে জামালপুর মহকুমা, বর্তমানে জামালপুর জেলা, চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা বিজয় লাভ করে। এ সময় হাজারো মুক্তিগামী জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে। স্বাধীন বাংলার বিজয়ের পতাকা উড়তে থাকে জামালপুরের সর্বত্র।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version