রংপুরের পায়রাবন্দের মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার বসতবাড়ি, কবরস্থান, মাজার শরিফ ও পায়রাবন্দ হাটের জমি দখলের পর বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। রোকেয়ার ৩৫০ বিঘা জমি বেদখল। জন্মের ১৪৪ বছর পরও রংপুরের বেগম রোকেয়ার উত্তরসূরীরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বিধান থাকলেও সরকার সহায়তায় এগিয়ে আসেনি। ফলে তার বাড়িটি পড়ে আছে জরাজীর্ণভাবে।
বেগম রোকেয়ার উত্তরসূরী রায়হান চৌধুরীর অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বেগম রোকেয়ার বাস্তুভিটার ৩০ শতক, কবরস্থান ২৩ শতক, মাজার শরিফ ৯ শতক এবং পায়রাবন্দ হাটের জমি ২০ শতক প্রভাবশালীদের দখলে। এছাড়াও রোকেয়ার সাড়ে তিন শত বিঘা জমি বেদখল। এসব জমি উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যরা।
উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর ভারতের কলকাতার সৈয়দপুরে তিনি মারা যান। এর মধ্যে বিলীন হয়েছে জমিদার পিতার বসতভিটা ও জায়গাজমি। বেগম রোকেয়ার পৈতৃক সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৩৫০ বিঘা জমি, যা বর্তমানে প্রভাবশালীদের দখলে।
রোকেয়ার নামে থাকা লাইব্রেরির আসবাবপত্র ভেঙে যাচ্ছে এবং নষ্ট হচ্ছে সবকিছু। তবে রোকেয়া দিবস পালন করা হচ্ছে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর। প্রশাসন ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের তৎপরতা এই দিন বাড়লেও, পরে আবার আগের মতো অবহেলায় পড়ে থাকে রোকেয়ার সবকিছু।
অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তিনি হয়েছিলেন বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত। তার বাবা আবু আলী হায়দার সাবের বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে রক্ষণশীল ছিলেন। বড় দুই ভাই-বোনের সহযোগিতায় তিনি গোপনে শিক্ষা লাভ ও সাহিত্য চর্চা করেন। ১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৯০৯ সালে তার স্বামী মারা যান। ১৯০২ সালে নবপ্রভা পত্রিকায় তার লেখা ‘পিপাসা’ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি পান।
১৯৫০ সালে মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য রচনা সুলতানাস ড্রিম, যার অনূদিত রূপ সুলতানার স্বপ্ন নারীবাদী সাহিত্যের মাইলফলক হিসেবে পরিচিত। তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর। প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।
বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, স্মৃতিচিহ্ন বলতে পৈতৃক বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এবং মূল ফটক রয়েছে, যা অবহেলায় কয়েক যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবছর ডিসেম্বর এলেই প্রশাসন ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাড়া পড়ে। তিনি আরও বলেন, রোকেয়ার সাড়ে তিন শ বিঘা জমি দখল করেছেন জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরীসহ অনেক প্রভাবশালী। তারা সবাই পায়রাবন্দ গ্রামের বাসিন্দা।
অভিযুক্ত কামরুজ্জামান চৌধুরী, আলমগীর হোসেন গং এবং জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, রোকেয়া পরিবারের কোনো জমি দখল করা হয়নি। পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে জমি তাদের। মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে। কয়েক যুগ ধরে আবাদ ও পুকুর খনন করে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
বেগম রোকেয়ার উত্তরসূরী রায়হান চৌধুরী বলেন, আমরা তার উত্তরসূরী হয়েও মানবেতর জীবনযাপন করছি। বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হয়েছি। বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। এছাড়া বেগম রোকেয়ার বসতভিটা, মাজার, কবরস্থান ও পায়রাবন্দ হাটবাজারের প্রায় ৮০ শতাংশ জমি এলাকার প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছেন। আমরা উক্ত জমিগুলো দখলমুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আবেদন দিয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিকার পাইনি।
এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, বেগম রোকেয়ার জমির বিষয়ে এবং তার দেহাবশেষ জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনতে যা যা করা দরকার, সবই করা হবে। রোকেয়ার বেদখল জমি উদ্ধারের কাজ চলমান রয়েছে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য