কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মান বন্ধ রাখতে সরকার পদক্ষেপ নিলেও গত এক যুগে মানিকগঞ্জে একশোর বেশি ইটভাটা কৃষি জমিতেই গড়ে উঠেছে। প্রশাসনের চোখের সামনেই এসব ইটভাটা গড়ে উঠলেও সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। নীরব থেকেই তারা ক্ষান্ত হননি, কৃষি জমিতে ইটভাটা পরিচালনা করতে কাগজে কলমে দিয়েছেন অনুমোদন,দিয়েছেন অনাপত্তিপত্র।
মানিকগঞ্জ জেলার ইটভাটাগুলোর গত একযুগের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে একশোর বেশি ইটভাটা কৃষি জমিতে নির্মানের প্রমান মিলেছে। এছাড়াও ওইসব ইটভাটার আশেপাশের স্থানীয় বাসিন্দারাও কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মানের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। চাষীদের কাছ থেকে কৃষি জমি লিজ নিয়েও গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা।
আইন বলছে, প্রতিটি ইটভাটা স্থাপনে ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স, কৃষি অফিসের অনাপত্তিপত্র, উপজেলা ভূমি অফিসের সুপারিশপত্র,জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ একাধিক অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কৃষিতে জমিতে ইটভাটা নির্মান পুরোপুরি নিষেধ থাকলেও এতগুলো তদারকি করা সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র খুব সহজেই পেয়েছে। শুধু তাই নয় অনায়াসে প্রতি বছর নবায়নের ছাড়পত্রও মিলছে। অভিযোগ রয়েছে, তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর অসাধু কর্তা ব্যক্তিদের ঘুষ দিয়ে এসব ইটভাটার লাইসেন্স নবায়ন করে নিচ্ছেন ভাটা মালিকরা। এছাড়া যারা নবায়ন করতে পারছেন না তারা আইনের ফাঁকফোঁকরে রিট করে ইটভাটা পরিচালনা করছেন।
প্রতি বছর তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রশাসন ইটভাটাগুলোতে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে জেল জরিমানাও করেন। স্থানীয়দের ভাষ্য, এসব অভিযান রুটিন ওয়ার্ক,লোক দেখানো। সত্যিই প্রশাসন যদি ইটভাটার দূষন নিয়ন্ত্রন করতে চাইতো তাহলে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার পরেও কিভাবে ভাটাগুলো চলে। এছাড়া কৃষি জমিতে ভাটাগুলো গড়ে উঠলেও প্রশাসন নীরব থেকেছেন। ফলে গত এক যুগে কৃষি জমিগুলো খালে পরিনত হয়েছে।
দুই ইউনিয়নে অর্ধ শতাধিক ভাটা
সবজি চাষে সুনাম কুড়িয়েছে সিংগাইর উপজেলা। এ উপজেলার সবজি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়। শুধুমাত্র বলধারা ও চান্দহর ইউনিয়নেই গড়ে উঠেছে অর্ধ শতাধিক ইটভাটা । অন্যদিকে জেলার অর্ধেক ইটভাটায় এ উপজেলায় অবস্থিত। কৃষি জমিতে কিভাবে ইটভাটাগুলো অনাপত্তি পেলো সিংগাইর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো:হাবিবুল বাশার চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দেড় বছরের বেশি সময় এখানে আছি। আমার সময়ে কোন ইটভাটার অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়নি। এ উপজেলাতে কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন কৃষিবিদ মো: টিপু সুলতান সপন। বর্তমানে তিনি কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর কুষ্টিয়াতে অতিরিক্ত উপপরিচালক ( হর্টিকালচার) পদে কর্মরত আছেন। তার কাছেও একই বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আপনি এ বিষয়ে বর্তমানে সিংগাইরে যিনি কর্মরত আছেন তার সাথে যোগোযোগ করেন। তার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে জানালে তিনি বলেন, আমার কর্মকালীন সময়ে কোন ইটভাটার অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়নি। জেলার কতগুলো ইটভাটা কৃষি অফিসের অনাপত্তিপত্র পেয়েছে তা জানতে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরে মানিকগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়েও জানা যায়নি। পরে লিখিতভাবে আবেদন করেও পাওয়া যায়নি তালিকা।
কৃষি জমির টপ সয়েল দিয়ে হচ্ছে ইট তৈরি
সিংগাইর উপজেলায় এক যুগ আগে আবাদযোগ্য জমির পরিমান ছিলো ১৬ হাজার ৩৫৮ হেক্টর। ২০২২ সালে তা এসে দাড়ায় ১৬ হাজার ২৪৫ হেক্টর। বিগত এক যুগে আবাদযোগ্য জমি কমেছে ১১৩ হেক্টর বা ৮৫০ বিঘা জমি। এসব জমির মাটি দিন দিন গেছে ইটভাটার পেটে। এ উপজেলার বিলবাড়ির চক, বলধারা, খোলাপাড়া, হুনাখালি চক, বায়রার সানাইল ও চারিগ্রামের বালিয়াডাঙ্গী চকে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় জলাশয়, যা ১০ বছর আগে ছিল ফসলি জমি। এছাড়াও মানিকগঞ্জের বাকি উপজেলাতেও ফসলি জমির টপ সয়েল যায় ইটভাটায়। ফলে দিন দিন কৃষি জমি জলাশয়ে পরিণত হচ্ছে।
বায়রার সানাইল এলাকার কৃষক রুস্তম মোল্লা বলেন, সানাইল চকে আমার ২০ শতাংশ জমি ছিলো। ভালোই চাষ হতো। তিন বছর আগে আমার জমির পাশের জমি থেকে ইটভাটার মাটি নেওয়া শুরু করে। পাশের জমি থেকে মাটি নেওয়ায় আমার জমিতে ভাঙন ধরে। মাটিখেকোরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবাদ করা যায়না। পরে বাধ্য হয়ে আমার জমির মাটিও বিক্রি করে দিছি। এভাবেই কৃষি জমিগুলো ডোবায় পরিনত হয়েছে।
চারিগ্রাম এলাকার মনির মিয়া বলেন, প্রথম দিকে কৃষি জমিতে একটা ভাটা গইরা উঠে। পরে বছর যায় ভাটার বাড়ে। জমিনগুলার মাটিও সব নিয়া যায়। না দিলে ঝামেলা করে। আমাগো মাটি না দিয়া কোন উপায় ন্যাই।
প্রতি বছর মিলছে ইট পোড়ানোর অনুমোদন
ইটভাটাগুলোকে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইট পোড়ানোর অনুমোদন নিতে হয়। নানা শর্তে ইট পোড়ানোর অনুমোদন নিলেও মাঠ পর্যায়ে তা পালন করেন না ভাটা মালিকরা। কৃষি জমিতে ইটভাটা,পরিবেশ দূষনের অভিযোগ, কৃষি জমির টপ সয়েল কর্তন , স্বাস্থ্য সুরক্ষা অনিশ্চিতসহ একাধিক দৃশ্যমান কর্মকান্ডের পরেও এসব ইটভাটাগুলোকে ইট পোড়ানোর অনুমোদন দেয় জেলা প্রশাসন। গত এক যুগে বিভিন্ন ইটভাটায় আইন ভঙ্গ করায় জেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেছেন। একদিকে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা অপরদিকে প্রতি বছর ইট পোড়ানোর লাইসেন্স প্রদান করা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠে।
লেমুবাড়ি এলাকার তুষার মিয়া বলেন, প্রশাসন প্রতি বছর কৃষি জমিতে মাটি কাটা ও ইটভাটার দূষনরোধে অভিযান পরিচালনা্ করে। কিন্তু অভিযান তেমন কোন কাজে আসেনা।
এবিসি ইটভাটার ব্যবস্থাপক আরফান দেওয়ান বলেন, সরকারি নিয়ম নীতি পুরোপুরি মেনে ভাটা পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য। স্থানীয় প্রশাসন যেভাবে বলে সেভাবেই ইটভাটা পরিচালনা করা হয়। সবাই যেভাবে ভাটা পরিচালনা করেন আমরাও সেভাবে করি।
অভিযোগ করেও মেলেনি প্রতিকার
২০১৭ সালে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার দীঘি ইউনিয়নের ভাটবাউর মৌজায় নতুন ইটভাটা নির্মাণকে কেন্দ্র করে কৃষক ও ভাটার মালিকের মধ্যে দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। ফসলি জমিতে ইটভাটা না করার জন্য ২৪৭ জন কৃষক স্বাক্ষরিত একটি আবেদন জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদফতরসহ বিভিন্ন দফতরে জমা দেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময়ে দায়িত্বরত সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সরেজমিনে একাধিকবার ইটভাটা এলাকা পরিদর্শন ও তদন্ত করেন। তবে ওই এলাকায় ফসলি জমি বাঁচেনি। বছর গড়িয়েছে আরো ইটভাটা গড়ে উঠেছে। হরিরামপুর উপজেলা সহকারী কমিশনারের কাছে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৫৬ জন কৃষক ইটভাটার মাটিকাটা বন্ধে অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগের কোন সুরাহা করেনি প্রশাসন। চলতি বছরও এ উপজেলায় ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে.কৃষি জমির মাটিও যাচ্ছে। গত এক যুগে কৃষি জমিতে ইটভাটা বন্ধ ও কৃষি জমির মাটি কাটা বন্ধে একাধিক অভিযোগ হয়েছে। তবে এতো এতো অভিযোগের পরেও প্রশাসনের দায়িত্বরতরা কৃষকদের পাশে দাড়ায়নি। ভাটা মালিকদের লোভনীয় টাকার ফাঁদে পড়ে কৃষি জমির সর্বনাশ করেছেন।
কি বলছেন পরিবেশবাদীরা
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশের মধ্যে কক্সবাজার, কুষ্টিয়া ও মানিকগঞ্জ জেলায় কৃষিজমির বাণিজ্যিক ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। কৃষিজমি সুরক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় কমছে জমি। বড় ধরনের বিপর্যয়ের আগেই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মানিকগঞ্জ কৃষি জমি সুরক্ষা কমিটির সমন্বয়কারী মো: নজরুল ইসলাম বলেন ,ইট তৈরিতে পোড়ানো হয় শত শত একর জমির উর্বর অংশ, বিলীন হচ্ছে গ্রামের ঐতিহ্য। ইট ভাটার মালিকেরা কৃষকদের এককালীন কিছু টাকার বিনিময়ে চাষাবাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জমির উপরি অংশের মাটি কেটে নিয়ে যায় ইট তৈরির উপাদান হিসেবে। আজকের এই আধুনিক বিশ্বে ইটের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নিয়ম না মেনে চাষের জমি ক্ষতি করে প্রয়োজনীয় বস্তু তৈরিতে ক্ষতিগ্রস্ত করছে পরিবেশ, মানুষের সামগ্রিক স্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য, উর্বর মাটি ও বায়ু। যারা আইন না মেনে ভাটা করেছেন এবং যারা অনুমোদন দিয়েছেন সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।
কি বলছেন প্রশাসন
সিংগাইর সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো:হাবিবুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসন প্রতিটি ইটভাটার লাইসেন্স প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট উপজেলা ভূমি অফিসে ভাটা স্থাপনের জমি সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত বা প্রতিবেদন চেয়ে থাকেন। সিংগাইরের ইটভাটাগুলোর মতামত বা প্রতিবেদন আগে দেওয়া হয়েছে। আমার সময়ে কোন মতামত বা প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি।
সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) মো: কামরুল হাসান সোহাগ বলেন, কৃষি জমিতে ইটভাটা গড়ে থাকলে কেউ যদি এ বিষয়ে অভিযোগ করেন সেক্ষেত্রে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড.মো: ইউসুফ আলী বলেন, মানিকগঞ্জ জেলায় ১১৫ টি ইটভাটার ছাড়পত্র রয়েছে। এছাড়া আরো ১৫ টি ইটভাটা ছাড়পত্রবিহীন পরিচালিত হচ্ছে। এসব ভাটায় অভিযান পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে। ইটভাটাগুলো পরিবেশ আইন না মানার পরেও কিভাবে নবায়নের ছাড়পত্র পাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি ইটভাটা পরিদর্শন করে নবায়নযোগ্য হওয়ায় ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড.রবীআহ নুর আহমেদ বলেন, অনাবাদি জমি ছাড়া ইটভাটার অনাপত্তিপত্র উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা প্রদান করতে পারেন না। অনেক সময় কৃষি অফিসের অনাপত্তিপত্র ছাড়াই ইটভাটাগুলো নির্মান হয়েছে। বর্তমানে কোন কৃষি জমিতে ইটভাটার অনুমোদন বন্ধে উপজেলা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কৃষি অফিসের অনাপত্তি ছাড়াও অনেক ইটভাটা গড়ে উঠেছে বলেও জানান তিনি।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড.মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, দ্রত অবৈধ্য ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। সরকারি বিধিমালার আলোকে পরিবেশ বান্ধব ইটভাটা নির্মানে ভাটা মালিকদের সহযোগিতা করা হবে। আইন না মেনে ইটভাটা পরিচালনা করার সুযোগ নেই। যদি কেউ আইন অমান্য করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগভাবে ব্যভস্থা গ্রহন করা হবে।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য