প্রবেশপথেই চোখে পড়ে দুটি ঘাটসহ একটি বিশাল পুকুর। পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে নান্দনিক এক মসজিদ। মসজিদের ভেতর-বাইরের কারুকাজ সহজেই মুগ্ধ করে। মসজিদের পাশে রয়েছে জমিদার পরিবারের বংশধরদের সমাধি। সামনের খোলা উঠানে শিশু-কিশোররা খেলাধুলায় মেতে থাকে। সবুজে ঘেরা এ প্রাঙ্গণজুড়ে রয়েছে পুরোনো লিচু, বেলসহ নানা ফলদ ও বনজ গাছ।
এটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার ঐতিহাসিক জমিদার মনোহর আলী খানের মিয়াবাড়ি, যা কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের বড়উঠান ইউনিয়নের মিয়ারহাট এলাকায় অবস্থিত। শত বছরের পুরনো এই জমিদারবাড়ি বর্তমানে সংরক্ষণের অভাবে প্রায় বিলুপ্তির পথে।
জরাজীর্ণ ভবন, হারাতে বসা ঐতিহ্য
সরেজমিনে দেখা যায়, মিয়াবাড়ির পুকুরে দুটি ঘাটের মধ্যে একটি সংস্কার করা হয়েছে, তবে অপরটি নষ্ট হয়ে গেছে। মূল ভবনের সামনের কাছারি ঘরটি ভেঙে পড়েছে, যেটি পেরিয়ে মূল বাড়িতে যেতে হয়। মূল বাড়ির সামনে বড় খোলা উঠান, যেখানে শিশু-কিশোররা খেলাধুলায় মেতে থাকে। তবে ভবনের দেয়াল ভেঙে পড়া, আগাছায় ভরে যাওয়া ভেতর-বাইরে পুরো স্থাপনাটিকে প্রায় ভুতুরে রূপ দিয়েছে।
জমিদার পরিবারের ইতিহাস
স্থানীয়রা জানান, কয়েকশ বছর আগে জমিদার মনোহর আলী খান ছিলেন এই পরিবারের ১৬তম প্রজন্ম। ১৬৬৫ সালে তাঁদের পূর্বপুরুষ এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। কেউ কেউ বলেন, তাঁরা রাজা শ্যামরায়ের বংশধর এবং মূলত শায়েস্তা খানের বংশের লোক। শায়েস্তা খান তাঁর জমিদারির ২৫ শতাংশ দেওয়ান মনোহর আলী খানকে দান করেছিলেন, যা থেকেই এই জমিদারির শুরু। পাকিস্তান আমলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় তাঁদের জমিদারি কার্যক্রমেরও অবসান ঘটে।
জানা যায়, জমিদারবাড়ির সামনের ঘরটি অতিথিদের বসার জন্য এবং খাজনা আদায়ের কাজে ব্যবহৃত হতো। এখানে বিচার কার্যক্রমও পরিচালিত হতো। বাড়ির একপাশে ছিল বিশাল ধানের গোলা, অন্যপাশে বিনোদন কেন্দ্র, যেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। দ্বিতল ভবনটি ছয়টি কক্ষ এবং দুটি শৌচাগারসহ নির্মিত হয়েছিল। ভবন নির্মাণে বিশেষ চারকোনা ইট ও চুন সুরকির ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান অবস্থা
জমিদারের বংশধররা ষাটের দশক থেকে মূল ভবনে বসবাস বন্ধ করে দেন। পরবর্তী সময়ে পেছনে একটি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়, যা এখনও বসবাসযোগ্য। বর্তমানে মিয়াবাড়ির দেখভালের দায়িত্বে থাকা রহিমা আক্তার জানান, বর্তমান মিয়া পরিবারের তিন সদস্য শহর ও দেশের বাইরে বসবাস করেন। তাঁরা মাঝে মাঝে এখানে এলেও বাড়ির পুরোনো অংশটি সংস্কার করেননি। প্রতিবছর একবার পুরো বাড়ি ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা হয়।
সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
জমিদার মনোহর আলী খানের ১৯তম বংশধর সাজ্জাদ উদ্দিন মিঠু বলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষ ১৬৬৫ সালে জমিদারি শুরু করেন। শত বছরের জমিদারি ইতিহাসের পর ১৯৫৪ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। জমিদারবাড়ির ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের জানা প্রয়োজন। ঐতিহ্য রক্ষায় এর সংস্কার জরুরি।”
বড়উঠান ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সাজ্জাদ খান সুমন বলেন, “এটি আমাদের এলাকার গর্ব। তবে ভবনটি অতিপ্রাচীন হওয়ায় সংস্কারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। মসজিদ, পুকুরের ঘাটসহ আশপাশের কিছু অংশ সংস্কার করা হয়েছে।”
মিয়াবাড়ি কর্ণফুলীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটির যথাযথ সংরক্ষণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য