পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে হাফেজ মোঃ ওমর ফারুক নামে এক প্রধান শিক্ষককে চাকরি ছাড়ার জন্য মামলা দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার হোসেন মাসুদ। এর ধারাবাহিকতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার মিরপুরে নিহত আশরাফুল ইসলাম হত্যা মামলায় চিংগুড়িয়া এন.আই.এইচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ ওমর ফারুককে গত ১২ ডিসেম্বর গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গ্রেফতার হওয়া প্রধান শিক্ষকের পরিবারের দাবি, তাকে হয়রানিমূলকভাবে আসামি করা হয়েছে। ঘটনার দিন ৪ আগস্ট ওমর ফারুক নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রত্যয়নপত্র রয়েছে। গ্রেফতার হওয়ার পর মুঠোফোনে হুমকির অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের কথোপকথনের অডিওতে আওয়ামী লীগ নেতা প্রধান শিক্ষককে যা বলেছেন -
“তোমারে যে তিন মাস সময় দেওয়া হইছে, তুমি যদি তিন মাসের ভিতরে ব্যবস্থা কর তাহলে তুমি ভদ্রভাবে চুপচাপ চলে যাবা। কেউ জানবে না। তিন মাস পরে যত রকমের নোংরা কেস আছে ঢাকা শহরে সব কেসে তোমার নামে কিন্তু প্রতি সপ্তাহে ওয়ারেন্ট যাবে। আমি ম্যানেজিং কমিটির (গোয়াও) মারিনা। আমার ম্যানেজিং কমিটির রেজুলেশনেরও দরকার নাই। তোমার ওয়ারেন্ট যাবে, জামিন নিবা, সাসপেন্ড হবা। ওয়ারেন্ট যাবে, জামিন নিবা, সাসপেন্ড হবা। চলতেই থাকবে প্রতি সপ্তাহে। যতগুলা নোংরা নোংরা কেস আছে ঢাকা শহরে সবগুলায় তোমারে ঢুকাবো। আমার বিরুদ্ধে কথা বলা আমার বিরুদ্ধে দল করা। আমার প্রোডাকশন আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে সেই প্রোডাকশন আমি রাখবো কেন। তোমার তিন মাস সময় আছে, একুশে মে পর্যন্ত। বাইশে মে এর মধ্যে যদি তুমি গুছাইতে পারো, বাইশে মে এর পরে দেখবা আনে তোমার কি কি হয়। খলিল মীর (সাবেক সভাপতি) তো মরেগেছে ইসের চোটে, তুমি যাবা জেল খাটতে খাটতে। জামাত শিবির কত কিছু বানাইতে পারবো আমি, দেখবা আনে কি কি পারে একটা উকিলে। সব সন্ধ্যার মধ্যে লিখিত জমা দাও চুপচাপ তিন মাসের ভেতরে চলে যাও। আর কোন কথা নাই।”
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৩০ জুন ওমর ফারুক চিংগুড়িয়া এন.আই.এইচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। তখন থেকেই বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন অ্যাডভোকেট আখতার হোসেন মাসুদ। চাকরির প্রথম দিকে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও দিন যত গড়ায় সভাপতির অনৈতিক চাহিদা এবং স্বৈরাচারী আচরণ বৃদ্ধি পায়। প্রধান শিক্ষক সভাপতির অনৈতিক চাহিদা এবং স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে গেলে তিনি রোষানলে পড়েন। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের সাথে অ্যাডভোকেট আখতার হোসেন মাসুদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় তার নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্ম শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় ২০২০ সাল থেকে বিদ্যালয় থেকে চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার চাপ দিতে থাকেন সভাপতি। এরপর থেকে অ্যাডভোকেট আখতার হোসেন মাসুদকে বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি না করায় নানা কূটকৌশল শুরু করেন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
কূটকৌশলের অংশ হিসেবে পিরোজপুর কোর্টে দুটি মামলা করেন। একটি মামলা থেকে প্রধান শিক্ষক অব্যাহতি পান। অন্য মামলাটি চলমান রয়েছে। অ্যাডভোকেট আখতার হোসেন মাসুদ ঢাকা মিরপুরে বসবাস করার সুবাদে মিরপুরে নিহত আশরাফুল ইসলাম হত্যা মামলায় প্রধান শিক্ষক ওমর ফারুককে সেই মামলায় জড়িয়ে দেন। এই মামলায় গত ১২ ডিসেম্বর তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এ বিষয়ে চিংগুড়িয়া এন.আই.এইচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক আব্দুর রহমান খান জানান, ঘটনার দিন ৪ আগস্ট প্রধান শিক্ষক ওমর ফারুক বিদ্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। তাকে ষড়যন্ত্র করে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
গ্রেফতার প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী ফাতিমা খানম বলেন, ‘আমার স্বামী ওমর ফারুক একজন নিরীহ মানুষ। তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ভান্ডারিয়ায় ছিলেন, ঢাকায় যাননি। এছাড়া তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি এবং পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার হোসেন মাসুদের সঙ্গে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এর জেরে অ্যাডভোকেট মাসুদ বিদ্যালয়ের সভাপতি না হতে পেরে ষড়যন্ত্র করে আমার স্বামীকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এ মামলায় আসামি বানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, আমার স্বামীকে হয়রানির জন্য আরও দুইটি মিথ্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। আমি প্রশাসনের কাছে এর সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায় বিচারের জন্য আবেদন জানাচ্ছি।’
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পিরোজপুর জেলা আওয়ামীলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এ্যাডভোকেট আখতার হোসেন মাসুদ পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি। এবং তার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হয় এই প্রতিবেদককের ফোন তিনি রিসিভ করেন নাই।
ভান্ডারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহমদ আনওয়ার বলেন, ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত আশরাফুল ইসলাম হত্যার দায়ে মিরপুর থানায় দায়েরকৃত হত্যা মামলায় শিক্ষক ওমর ফারুককে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভান্ডারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি মোঃ ইয়াছিন আরাফাত রানা জানান, আমার জানা মতে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত নন। তিনি একজন কুরআনের হাফেজ। বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতির সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব থাকায় এ ঘটনা ঘটতে পারে।
পিরোজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মঠবাড়িয়া-ভান্ডারিয়া সার্কেল) মোঃ সাখাওয়াত হোসেন জানান, প্রধান শিক্ষক মোঃ ওমর ফারুক মিরপুর মডেল থানার আশরাফুল ইসলাম হত্যা মামলার ৪০ নম্বর এজাহারভুক্ত আসামি।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য