গাইবান্ধায় নদীভাঙন

‘নদী ভাঙার হাত থাকি হামাঘরোক বাঁচান’

রিফাতুন্নবী রিফাত, গাইবান্ধা
‘নদী ভাঙার হাত থাকি হামাঘরোক বাঁচান’

হামরা (আমরা) আর কেংকা (কেমন) করি বাঁচি বাহে তোমরাগুলাই কও। এই সর্বনাশা নদী (নদ) হামাঘরের (আমাদের) সবকিছু কারি নিছে (কেড়ে নিয়েছে)। অ্যাক (এক) বিগা জমি আছিল (ছিল), তাতে ভুট্টা নাগাচিনো (লাগিয়েছিলাম)। দশ-পনেরো দিন আগোত (আসতেই) নদীত চলি গেছে। হামরা সরকারের কাছে কিচ্ছু (কিছু) চাই না, নদী ভাঙার হাত থাকি হামাঘরোক বাঁচান। তাতেই হামরাগুলা (আমরা) খুশি হমো বাবা। কান্না জড়িত কন্ঠে এসব কথা বলছিলেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের পুটিমারী গ্রামের বাসিন্দা মমিনুল ইসলাম।

শুরু মমিনুল ইসলামেই নন, তার মতো অবস্থা একই গ্রামের কৃষক আবদুল্লারও। দেড় বিঘা জমিতে তিনি বিভিন্ন সবজি চাষ করেছিলেন। কয়েক দিন আগে সেই জমি ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়ে যায়।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে অসময়ে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের কারণে তারা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। হঠাৎ আগ্রাসী হয়ে ওঠা ব্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাসের কাছে নদতীরবর্তী সব মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। প্রায় চার সপ্তাহের ব্যবধানে উপজেলার অর্ধশতাধিক পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে।

৩০০ একর আবাদি জমি ও অসংখ্য গাছপালা নদীতে হারিয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে আরও ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি। বাধ্য হয়ে অনেকে বাঁধে বসবাস শুরু করেছেন। কেউ কেউ আবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এমন পরিস্থিতিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, ভাঙনরোধে এই মুহূর্তে তাদের কাছে কোনো প্রকল্প নেই। সমীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রকল্প প্রণয়নের কাজ চলছে।ভাঙন এলাকার বাসিন্দারা জানান, সুন্দরগঞ্জে গত চার সপ্তাহ ধরে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। শ্রীপুর ইউনিয়নের বোয়ালীর চর, মাদারীপাড়া, কানি চরিতাবাড়ি ও ফুলমিয়া বাজারসহ অন্তত ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। কয়েকটি গ্রামের অন্তত ২০০ বিঘা উঠতি শীতকালীন ফসলের জমি, অসংখ্য গাছপালা বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন আরও তীব্র হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায়। কেউ জমিতে বেগুন চাষ করেছিলেন। কেউবা আবার শীতকালীন বিভিন্ন সবজির আবাদ করেছেন। তারা সবাই পরিপক্ব হওয়ার আগেই ফসল কেটে ফেলছেন। নদীর তীরে থাকা প্রত্যেকের মুখে ছিল চিন্তার ছাপ।

উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামের কৃষক আজাদ মিয়া বলেন, ‘গত এক মাসে নদীভাঙনে আমার পাঁচ বিঘা জমি বিলীন হয়ে গেছে। এর মধ্যে চার বিঘা ছিল ফসলি জমি। ভাঙনের ভয়ে ফসল পরিপক্ব না হতেই তুলতে হয়েছে। কিন্তু ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

ওই গ্রামের বাসিন্দা মোকলেছুর রহমান বলেন, ভাঙনরোধে গত ৩০ ডিসেম্বর পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ৫০টি জিওব্যাগ ফেলা হয়। এরপর তাদের আর কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘পুটিমারি থেকে দত্তপাড়া, দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামে প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ ফুট এলাকা বিলীন হচ্ছে। শীতকালীন নানা জাতের ফসলের জমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অনেক ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে। এভাবে ভাঙতে থাকলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গোটা গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পাউবো কাজ করলেও তার অগ্রগতি নেই।’

এ বিষয়ে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, নভেম্বর, ডিসেম্বরে সুন্দরগঞ্জের ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। পুটিমারি থেকে দত্তপাড়া পর্যন্ত ১৫০০ মিটার এলাকা ভাঙনের কবলে পড়েছে। এই মুহূর্তে ভাঙনরোধে কোনো প্রকল্প নেই। তবে ১৬০ মিটার এলাকাজুড়ে জিওব্যাগ ফেলা অব্যাহত রয়েছে। স্থায়ী সমাধানের জন্য সমীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এখন প্রকল্প প্রণয়নের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

মন্তব্য