পিরোজপুরের নাজিরপুরে

শতবর্ষের ঐতিহ্য: রাতভর চিতই পিঠা উৎসব

এস. এম. সিপার, নাজিরপুর (পিরোজপুর) প্রতিনিধি
শতবর্ষের ঐতিহ্য: রাতভর চিতই পিঠা উৎসব

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার কুমারখালী গ্রামের একটি মন্দির প্রাঙ্গণে প্রতি বছর মাঘের অমাবস্যা তিথিতে রাতভর চিতই পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

উৎসবটি নাজিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের কুমারখালী বাজার সংলগ্ন দেবলাল চক্রবর্তীর বাড়িতে আয়োজিত হয়। একশত একখানা মন্দিরের সামনে বিশাল আকৃতির বটগাছের নিচে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় শুরু হয়ে পরদিন সকালে শেষ হওয়া এ আয়োজনে প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে হাজারো মানুষের ভিড় জমে। অন্যান্য বছরের মতো এবারও মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় শুরু হয়ে উৎসব শেষ হয় বুধবার (২৯ জানুয়ারি) সকালে।

এ উৎসবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। যদিও এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আয়োজন, তবে স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মের মানুষও অনুষ্ঠান উপভোগ করতে এখানে আসেন। কালী মন্দিরকে কেন্দ্র করেই মূলত এ উৎসবের আয়োজন করা হয়।

পিঠা উৎসবের ঐতিহাসিক পটভূমি

মন্দির কমিটির সভাপতি অমৃত লাল দাস জানান, প্রায় শত বছরেরও বেশি সময় ধরে এই চিতই পিঠা উৎসব হয়ে আসছে। প্রতি বছরের মাঘের অমাবস্যা তিথিতে কালী মন্দিরে এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মন্দিরের ভক্তসহ বিভিন্ন লোকজন এখানে আসেন। বিশেষ করে যেসব নারীদের সন্তান হয় না (বন্ধ্যা), তারা মানত করতে আসেন এবং সন্তান লাভের পর চিতই পিঠা উৎসবে অংশ নেন।

তিনি আরও জানান, পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শোনা কথানুযায়ী, এক মা প্রথমবার সন্তান লাভের জন্য এখানে মানত করেন। পরে তার মনোবাসনা পূর্ণ হলে, তিনি কালী মায়ের চরণে চিতই পিঠা উৎসর্গ করেন এবং উপস্থিত সবাইকে খাওয়ান। সেই থেকেই এ উৎসবের প্রচলন ঘটে। ফলে এটি পরিচিতি পায় "শতবর্ষের চিতই পিঠা উৎসব" নামে।

পিঠা উৎসবের আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা

মন্দিরের দায়িত্বে থাকা পুরোহিত দেবলাল চক্রবর্তী জানান, প্রায় শত বছর আগে তার পূর্বপুরুষ হরষিত আনন্দ চক্রবর্তী এই উৎসবের সূচনা করেন। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তরা এখানে সমবেত হন।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে হাজারো মানুষের উপস্থিতি। অনেক দম্পতির কোলে ছোট শিশু সন্তান দেখা গেছে। উৎসবস্থলে ১০১টি মাটির চুলা সারি করে বসানো হয়, প্রতিটি চুলার ওপর মাটির সাজে চিতই পিঠা তৈরি করা হয়। পাশেই ঢোল-কাশিসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়, যা উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।

উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় পুরোহিত দেবলালের চুলায় লোহার পাত দিয়ে আঘাত করার মাধ্যমে। এরপর চুলার সাজে ফুল দিয়ে, পরে আগুন জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। হিন্দু নারীরা উলু ধ্বনি দিয়ে শুভ সূচনা করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে ১০১টি চুলায় বিভিন্ন বয়সের নারীরা পিঠা তৈরিতে অংশ নেন। উদ্‌যাপন কমিটির সদস্যরা পিঠা তৈরির উপকরণ হিসেবে চালের গুঁড়ার গোলা সরবরাহ করেন।

এ ছাড়া, কালী মন্দিরের সামনের বিশাল আকৃতির বটগাছের উঁচুতে বসে এক পুরোহিত একটি চুলায় চিতই পিঠা তৈরি করছিলেন, যা উৎসবের অন্যতম আকর্ষণীয় দৃশ্য ছিল।

মন্তব্য