অন্যের জমিতে কাজ করে মেডিকেলে চান্স পেলেন মারুফ

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
অন্যের জমিতে কাজ করে মেডিকেলে চান্স পেলেন মারুফ

শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রায় সময় কাজে যেতে পারতেন না ইউসুফ আলী। একদিন খাবার না খেলেও চলবে, কিন্তু ওষুধ প্রতিনিয়তই সেবন করতে হয় তাকে। একদিকে পাঁচ সদস্যের পরিবারের দায়িত্ব ও সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, আর অন্যদিকে অসুস্থতা—সব মিলে যেন অন্ধকার দেখছিলেন তিনি। বাবার এই অসহায়ত্বের করুণ দৃশ্য দেখে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তার বড় ছেলে মারুফ হাসান। নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে মাঠে যান শ্রম দিতে। অন্যের জমিতে কামলা দিয়ে যে মজুরি পান, তা দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ ও বাবার ওষুধের পেছনে ব্যয় করেন। তবুও যেন দরিদ্র ঘরের এই অন্ধকার কাটছেই না। তবে সেই অন্ধকারে এবার প্রদীপ জ্বালিয়েছে মারুফ হাসান। সেই প্রদীপের আলোতেই আলোকিত হয়েছে ইউসুফ আলীর ঘর।

দারিদ্র্যকে জয় করে মারুফ রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। মারুফের এ সাফল্যে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের মানুষ আনন্দিত। কিন্তু তার দরিদ্র পরিবারের পক্ষে মেডিকেলের খরচ জোগান দেওয়া আদৌ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।

মারুফ হাসানের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার লেহেম্বা ইউনিয়নের শালবাড়ি এলাকার কাঠালবাড়ি গ্রামে। তিনি ইউসুফ আলী-মরিয়ম বেগম দম্পতির ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মারুফ সবার বড়। বসতভিটা ছাড়া তাদের তেমন সম্পত্তি নেই। অসুস্থ বাবা অন্যের দোকানে কাজ করে যে রোজগার করেন, তা দিয়ে সংসার চলে। আর মারুফ অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে যে আয় করতেন, তা দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারকেও সহায়তা করতেন।

এলাকাবাসী ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মারুফ হাসান রাণীশংকৈল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এরপর ভর্তি হন রাণীশংকৈল ডিগ্রি কলেজে। সেখানেও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেন। এ বছর এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। ভর্তিসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ যে অর্থের প্রয়োজন, তা মারুফের হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, নিজের যা সম্পত্তি ছিল, তা বন্ধক রেখে সন্তানদের পড়াশোনার পেছনে ব্যয় করেছেন ইউসুফ আলী। বন্ধুর কীটনাশকের দোকানে কাজ করে যে বেতন পান, তা দিয়েই সংসার চলে।

মারুফ হাসানের বাবা ইউসুফ আলী জানান, পৈতৃক সূত্রে ২০ শতাংশ ও শ্বশুরের দেওয়া ৩৩ শতাংশ জমি পান তিনি। এর মধ্যে ২০ শতাংশ জমি ছেলের লেখাপড়ার খরচের জন্য বন্ধক রেখেছেন। আর ৩৩ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করে যে ফসল হয়, তা দিয়েই সংসার চলে। ইউসুফ আলী ২০০৬ সাল থেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ। ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না। এদিকে কাজ না করলে আবার চুলোয় হাঁড়ি চড়ে না। তাই অসুস্থ শরীর নিয়েই বাড়ির পাশে এক কীটনাশকের দোকানে কাজ নেন। কাজ করে যে টাকা পান, তা দিয়েই সংসার চলে।

তিনি আরও জানান, দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বহু ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়েছেন। সেই থেকে স্বপ্ন দেখতেন, যদি তার সন্তানকেও ডাক্তার বানাতে পারতেন! একথা শুনে বড় ছেলে মারুফ গত বছর এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু মাত্র ৩ নম্বরের জন্য মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। তারপরও থেমে যায়নি মারুফ। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশ নেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিষয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু কৃষি বিষয়ে তার আগ্রহ কম থাকায় বাড়ি ফিরে আসে। এরপর এলাকায় একটি কোচিংয়ে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। এবার এমবিবিএস পরীক্ষায় আর তাকে থামাতে পারেনি কেউ। শত কষ্টের পরও আমার ছেলে রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সে আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে। আমার সব কষ্ট সার্থক হয়েছে। মেডিকেলে চান্স পাওয়ায় গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠে। কিন্তু ওখানে অনেক টাকা-পয়সা লাগে। আমার পক্ষে তা সম্ভব না।

মারুফের মা মরিয়ম বেগম বলেন, "আমার বড় ছেলে অভাবের মধ্যেই পড়ালেখা করেছে। আমি চাই, সে বড় ডাক্তার হোক। গরিব মানুষকে বিনা টাকায় চিকিৎসা করুক—এটাই আমার চাওয়া। আমি খুবই আনন্দিত।"

মারুফ বলেন, "আমার বাবা অসুস্থতা ও ডাক্তারের কাছে যাওয়া-আসা দেখেই আমার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা জন্মায়। এই পেশাটাকে আমার অন্যরকম ভালো লাগে। মনে হতো, আমি যদি তাঁদের মতো হতে পারতাম! সেভাবেই পড়াশোনা করি। তবে লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করতে মাঠেও কাজ করেছি, কারণ আমার পরিবারের পক্ষে এত খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। আমার অক্লান্ত পরিশ্রম ও মা-বাবার দোয়ায় আমি মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। দোয়া করবেন, যেন ভালো ডাক্তার হতে পারি। অসহায় ও দুস্থ মানুষের জন্য কিছু করতে চাই।"

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রকিবুল হাসান বলেন, "মারুফ হাসান মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় তাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। এছাড়াও, তার মেডিকেলে পড়াশোনায় সবসময় উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা থাকবে।"

মন্তব্য