-->

ভিন্নরকম থানাহাজত

রুদ্র মিজান, ইদ্রিস আলম
ভিন্নরকম থানাহাজত
ক্যাবিনেটে সারি সারি সাজানো ধর্মীয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের বই। ছবি- ভোরের আকাশ

থানাহাজত। আসামিদের গ্রেপ্তারের পর সাময়িক সময়ের জন্য রাখা হয় এখানে। আদালতে পাঠানোর আগ পর্যন্ত থানাহাজতেই রাখা হয় তাদের। হাজতখানার নাম শুনলেই মনে হবে গুমোট পরিবেশ, সেখানে থাকা কষ্টদায়ক। কিন্তু এই ধারণা আমূল পাল্টে দিয়েছে কমলাপুর রেলওয়ে থানার হাজতখানা।

থানার সামনে পা দিতেই মনে হতে পারে এর পরিবেশ ভিন্ন রকম। মূল সড়ক থেকে যেতে যেতেই চোখে পড়ে সামনে দায়িত্ব পালন করছেন সুইটি নামে একজন নারী কনস্টেবল। অদূরে আরেক পুলিশ সদস্য।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থানা ভবনের কক্ষগুলো। সামনের কক্ষে বসে আছেন ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক বিল্লাল। মাথার ওপরে দেয়ালের সঙ্গে সাঁটানো চোখজুড়ানো কারুকাজে তৈরি কাঠের একটি ক্যাবিনেট।

এটি কোনো আসবাবপত্র রাখার আলমারি বা শো-কেস নয়। ক্যাবিনেটে সারি সারি সাজানো ধর্মীয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের বই।

ভেতরে রয়েছে আরো চমক। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পরিদর্শক (তদন্ত)-এর কক্ষ। পাশেই অন্য অফিসারদের একটি কক্ষ। ডেস্ক, বেশ কয়েকটি চেয়ার। ভেতরে হাজতখানা। সামনে দায়িত্ব পালন করছেন একজন কনস্টেবল। হাজতখানায় মাদকসহ আটক এক আসামিকে রাখা হয়েছে।

বাইরে থেকে দেখেই মনে হচ্ছে হাজতখানার সুন্দর-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সহযোগিতায় থানার এই হাজতখানার ভেতরে গেলে স্পষ্ট দেখা যায়, ভিন্ন রকম এক পরিবেশ। দেশের অন্যান্য হাজতখানা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

শুরুতেই দেখে মনে হতে পারে, এটি কোনো ডুপ্লেক্স বাড়ির সাজানো কক্ষ বা একটি ছোট্ট পাঠাগার। বুকসেলফ রয়েছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘মুজিব বাংলার, মুজিব মুক্তিযুদ্ধের’ ‘বোখারি শরিফ’, ‘ফেসবুকের ধ্বংসলীলা’, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ ও ‘বিশ্বনবীর জীবনী’সহ নানা বই।

বই পড়তে পড়তে ক্লান্তি এলে বিশ্রামের জন্য রয়েছে পাথরের ওপর দামি টাইলসে তৈরি খাট। খাটে পরিপাটি করে রাখা আছে বালিশ-কম্বল। পাঠাগার ছাড়াও সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এখানে। রয়েছে আধুনিক একটি শৌচাগার।

পুলিশ সদস্যরা জানান, শুধু আইনি প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ না থানার কার্যক্রম। মানবতাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। জনবান্ধব পুলিশ গড়তেই এসব উদ্যোগ। আটক করা ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির ছাড়াও তাদের কাউন্সেলিং করা হয় এখানে। যেন অপরাধবোধ জাগ্রত হয়। সঠিক রাস্তায় চলতে উৎসাহবোধ করে।

একজন হাজতি জানান, থানাহাজতে এমন পরিবেশ কল্পনাও করেননি। সকালে তাকে এখানে নাশতা করতে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘসময় নিয়ে বোঝানো হয়েছে মাদকের কুফল এবং অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে।

এখানেই শেষ নয়। কমলাপুর রেলওয়ে থানা নজির স্থাপন করেছে কয়েকটি কর্মের মধ্য দিয়ে। রেলওয়ের টিকিট কাউন্টার হয়ে ভেতরের দিকে যেতেই চোখে পড়ে অন্যরকম এক দৃশ্যপট।

সুবর্ণা নামে এক নারী কনস্টেবল। তার এক হাতে পানির জার, অন্যহাতে চকলেট। অবশ্য তাকে সহযোগিতা করছেন আরেক কনস্টেবল। তৃষ্ণার্ত যাত্রীদের বিশুদ্ধ পানি পান করাচ্ছেন।

একইভাবে শিশুদের দেখলেই একটু হাসি উপহার দিয়ে কাছে টেনে নিচ্ছেন। আদর করতে করতে হাতে তুলে দিচ্ছেন চকলেট। প্রতিদিন সাত থেকে আট জার পানি পান করানো হচ্ছে।

রেলওয়ে থানার দায়িত্বরত উপপরিদর্শক (এসআই) রকিব জানান, তিনি সেখানে কয়েক মাস হয় এসেছেন। তিনি আসার পর থেকেই দেখছেন এই মহতী উদ্যোগ। যা তার চাকরিজীবনে এর আগে কখনো দেখেননি।

তিনি বলেন, গত এক বছরে থানার চিত্রই বদলে গেছে। কোনো সেবাপ্রার্থী যেন মনঃক্ষুণ্ন না হন, সেদিকে এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে অবকাঠামোয় পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর এর সবই করেছেন ঢাকা রেলওয়ে জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন স্যার। নিজস্ব অর্থায়নে পাঠাগারটি বাস্তবায়ন করেছেন তিনি।

ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ সম্পর্কে ঢাকা রেলওয়ে জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন বলেন, কোনো মানুষ হয়তো সাময়িক ভুলের কারণে অপরাধী হয়েছেন। হাজতে এসে তার মনোজগতের পরিবর্তন হতে পারে। নিজেকে সংশোধন করে তিনি সুন্দর মনের মানুষে পরিণত হতে পারেন। সেই চিন্তা থেকেই হাজতখানাকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে।

তিনি বলেন, তাছাড়া অনেকে অপরাধী না হয়ে আসামি হন। হাজতে আসতে হয়।

পুলিশ সদস্য থেকে শুরু করে কমলাপুর রেলওয়ে থানার এই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অবগত অন্যরাও চান এমন পরিবেশ ছড়িয়ে পড়ুক দেশের সকল থানায়। সেইসঙ্গে মানুষ প্রাপ্য সেবাটুকু পাক সহজেই। ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটুক মানসিকতায় ও পরিবেশে।

মন্তব্য

Beta version