-->
শিরোনাম

ডেরাবাবাদের ভণ্ডামি!

রুদ্র মিজান
ডেরাবাবাদের ভণ্ডামি!
প্রতারক এমএ মোতালেব চিশতী

মুশকিলে আসান! যে কোনো সমস্যায় সমাধান। চটকদার বিজ্ঞাপন ‘স্বামী-স্ত্রী অমিল, সাংসারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, মনের মানুষকে কাছে পাওয়া, পরকীয়া প্রেমে আসক্তি, দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থানকারীকে ফিরিয়ে আনা, কফিলকে বাধ্য করা, অবাধ্য ছেলে-মেয়েকে বাধ্য করা,

লেখাপড়ায় মনোযোগী করা, বিদেশে যাওয়ায় বাধা ও চাকরি-ব্যবসায় লোকসান দূর করা, শত্রুকে পরাস্ত করা, যাদু টোনা কাটানো, জ্বিন-পরির আছর থেকে মুক্তি ইত্যাদি সমস্যাগুলো প্রাচীন তান্ত্রিক শাস্ত্রের মাধ্যমে এক থেকে তিন দিনের মধ্যে গ্যারান্টিসহ সমাধান দেওয়া হয়।’ সাধারণ মানুষ সহজেই আকৃষ্ট হন এসব বিজ্ঞাপনে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব বিজ্ঞাপনে তান্ত্রিক সাধকের পরিচয় ও পুর্ণাঙ্গ ঠিকানা থাকে না। দেয়া হয় ফোন নম্বর। এতেই যোগাযোগ করেন নানা সমস্যায় জর্জরিত অসহায় মানুষ। সম্প্রতি বেশ কয়েক তান্ত্রিক, ভণ্ডপীর গ্রেপ্তারের পর আলোচনায় এসেছে তান্ত্রিক চিকিৎসা, তদবিরের নামে ভণ্ডামি।

গোয়েন্দারা জানান, দেশের প্রায় সর্বত্র এরকম অসংখ্য ভণ্ড রয়েছে। যারা মানুষের বিশ্বাস ও সরলতার সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করে যাচ্ছে।

ব্যক্তি জীবনে সমস্যায় জর্জরিত পুরান ঢাকার বাসিন্দা রাসেল মাহবুব জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেখে ফারুক নামে এক তান্ত্রিক কবিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি।

ফারুক জানান, তিনি সুনামের জন্য, মানুষের সেবার জন্য কবিরাজি-তদবির করেন। টাকা চান না। উপকার করলে দোয়া করলেই হবে। টাকা দিতে হবে না বলে জানান তিনি।

কথা শুনে বেশ ভালো লাগে রাসেলের। বিশ্বাস জন্মে। সমস্যা সম্পর্কে কবিরাজ ফারুককে জানান, তার মেয়ে বন্ধু তাকে ভুল বুঝেছে। রাগ করে কথা বন্ধ রেখেছে।

এ বিষয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রাসেল। মনের মানুষকে এভাবে দূরে রেখে শান্তি পাচ্ছেন না কিছুতেই। তান্ত্রিক কবিরাজের কাছে সহযোগিতা চান।

কবিরাজ ফারুক শুরুতেই দুজনের নাম ও ছবি চান। যথারীতি ইমোতে ছপি পাঠান রাসেল। এবার ফারুক জানান, মাগরিবের পর তিনি বিষয়টি বলতে পারবেন। মাগরিবের পর কথা হয় ফোনে। কবিরাজ ফারুক জানান, রাসেলের প্রেমিকাকে অন্য একজন ভালোবাসে।

ওই যুবক কোনোভাবেই চায় না রাসেল তার জীবনে থাক। তাই সে তাবিজ করেছে। তাবিজ রেখেছে ঢাকার পাশের একটি জেলার জঙ্গলে, মাটিতে। এটি খুঁজে বের করে নষ্ট করতে হবে।

জঙ্গলের গহীনে রাখা তাবিজটি মানুষ দ্বারা খোঁজে বের করা সম্ভব না। প্রয়োজন জ্বিন। কবিরাজ ফারুক ইতিমধ্যে জি¦নের সঙ্গে কথা বলেছেন। জি¦নগুলো তান্ত্রিক কবিরাজ ফারুকের বাধ্য। ফারুক বলেন, হুজুররা (জি¦ন) ৪০ কেজি মিষ্টি চেয়েছে। মিষ্টি দিলেই কাজ হবে।

রাসেলকে মিষ্টি পাঠাতে বলেন ফারুক। নতুবা মিষ্টি কেনার টাকা। তিনি আবারও জানিয়ে দেন, তিনি নিজের জন্য কোনো টাকা চাননি। শুধু দোয়া চান। রাসেলের কাছে এতো টাকা নেই। তবু প্রিয় মানুষকে কাছে পাওয়া নিয়ে কথা। অতঃপর ধার-দেনা করে দুই দফায় বিকাশ নম্বরে ১২ হাজার টাকা পাঠান রাসেল।

টাকা পেয়ে কবিরাজ ফারুক জানান, তদবির করা হয়েছে। হুজুররা কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তিনদিনের মধ্যে সমাধান হবে। না, তিনদিন গত হলেও রাসেলের প্রিয়তমা ফিরেনি তার কাছে। আগের মতোই অবস্থা। কল দেন কবিরাজ ফারুকের নম্বরে। হতাশ হন। নম্বর বন্ধ।

নিজেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা পরিচয় দেয়া কবিরাজ ফারুকের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি রাসেলের। সামাজিক কারণে রাসেলও কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।

তান্ত্রিক গুরু, ডেরাবাবাদের পোস্টার, লিফলেটের ছড়াছড়ি সর্বত্র। সম্প্রতি বেশ কয়েক ডেরাবাবা গ্রেপ্তার হওয়ার পর স্বীকার করেছেন এসবই হচ্ছে তাদের ভণ্ডামি। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে অর্থ আদায় থেকে শুরু করে কৌশলে নারীদের সম্ভ্রমহানি করেন তারা।

সামাজিক কারণে ও তান্ত্রিকদের ভয়ে সাধারণত মুখ খোলেন না নির্যাতিতারা। সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ডেরাবাবা আলী ওরফে মোহাম্মদ আলী। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় মামলা হয়েছে। র‌্যাব-পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন ৬২ বছর বয়সী ডেরাবাবা।

যুবক বয়স থেকেই অর্থ এবং নারীর নেশায় ভণ্ডামির এইপথ বেছে নেন ডেরাবাবা। মাদ্রাসায় কয়েক ক্লাস লেখাপড়া করেই আয়ত্ত করেছেন পানিপড়া ও তাবিজ লেখা। মাঝেমধ্যে তা প্রয়োগ করতেন। সমস্যায় পড়ে তার শরণাপন্ন হতেন অনেকেই।

গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে ডেরাবাবা স্বীকার করেছেন, একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়ে কবিরাজি করতেন তিনি। মূলত তিনি কিছুই জানেন না। না জেনেই বিভিন্নজনকে পানিপড়া দিতেন, তাবিজ দিতেন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা তাদের স্বামীকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে তার সহযোগিতা নিতেন। এই সুযোগে অনেক নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করেছেন ডেরাবাবা।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার বাথুয়া গ্রাম থেকে গত ২৪ জানুয়ারি তাকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৭। র‌্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. নূরুল আবছার জানান, দীর্ঘদিন থেকে কৌশলে তান্ত্রিকতার নামে নারীদের ফাঁদে ফেলে ভোগ করছিল এই ডেরাবাবা। সর্বশেষ মালয়েশিয়ার এক প্রবাসীর স্ত্রীকে চিকিৎসার নামে কৌশলে ধর্ষণ করেছেন ডেরাবাবা।

স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব ছিল ওই নারীর। স্বামীকে কাছে পেতেই দ্বারস্থ হয়েছিলেন ডেরাবাবার। প্রথম দফা সাক্ষাতে ওই নারীকে সমস্যা সমাধানের আশ্বস্ত করেন ডেরাবাবা। দেন তাবিজ-পানিপড়া।

ওই নারী তখন তাকে ৫ হাজার টাকা প্রদান করেন। সময় গড়িয়ে গেলেও কোনো উপকার পাননি তিনি। আবারও একইভাবে পানিপড়া ও তাবিজ দেন। বিনিময়ে নেন আরো ৫ হাজার টাকা। এবারও কোনো উপকার হয়নি। এবার সবচে ভালো ও কার্যকর কাজটি করবেন বলে জানান ডেরাবাবা।

ভুক্তভোগী নারীকে হাটহাজারীর বাথুয়া গ্রামে ডেরাবাবার বাসায় ডেকে নিয়ে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। রাজি না হলে পানিপড়ার নামে এক গ্লাস পানিতে চেতনানাশক মিশিয়ে পান করান তাকে।

সকাল ১১টায় পানি পান করার পর অজ্ঞান হয়ে যান ওই নারী। বেলা সাড়ে ৩টায় জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান তিনি প্রায় নগ্ন অবস্থায় ডেরাবাবার বিছানায়। বুঝতে পারেন তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর ডেরাবাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

হাটহাজারী থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মুজিবুর রহমান জানান, এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অনেককিছুই অস্বীকার করছে এই ডেরাবাবা। এরকম আরেক ডেরাবাবাকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

রাজধানীর ভাটারার খিলবাড়ি টেক পশ্চিমপাড়া এলাকায় ছিল তার আস্তানা। ওই আস্তানায় প্রতি সপ্তাহে এক রাতে সমবেত হতেন বিভিন্ন শ্রেণির নারী-পুরুষ। এমএ মোতালেব চিশতী নামে পরিচিত ৩৪ বছর বয়সী এই যুবককে পীর বলেই চিনেন পরিচিতজনরা।

নানা সমস্যা সমাধানের নামে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত ছিল। এমনকি রাজনৈতিক পরিচয়ও ব্যবহার করতো। সহস্রাধিক ছেলে নিয়ে এই কথিত পীর গঠন করেছিল কমিউনিটি। চাকরি দেওয়ার নামে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাত করার পর গ্রেপ্তার করা হয় সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার জয়শ্রী গ্রামের এই যুবককে।

এ ঘটনায় ভাটারা থানায় একটি মামলা করেন নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের কলুংকা গ্রামের নাজিমউদ্দিন। গত বছরের শেষের দিকে মোতালেব চিশতীকে উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।

ডিবি পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান জানান, সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামার আড়ালে সে একজন ভণ্ডপীর। তার বিরুদ্ধে ভাটারা ও খিলগাঁও থানায় দুটি মামলা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে অনেক। পীরের তকমা লাগিয়ে বিকৃত যৌনাচার ও প্রতারণা করে এমএ মোতালেব চিশতী।

এ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। সহজ সরল। মূলত সাধারণ মানুষের সরল বিশ্বাস অর্জন করে প্রতারণা করতেই ভণ্ডপীররা এমনটি করে থাকে বলে জানান তিনি।

 

মন্তব্য

Beta version