-->
শিরোনাম
ষড়যন্ত্রের শিকার নার্সিং পেশা

তিন মাসে এত বদলি! লেনদেন কত?

নিজস্ব প্রতিবেদক
তিন মাসে এত বদলি! লেনদেন কত?

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর-এই তিন মাসেই চার হাজারেরও বেশি নার্স বিভিন্ন হাসপাতালে বদলি হয়েছেন। এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, এমন ঘটনা এই সেবা খাতে প্রথম এবং ‘অস্বাভাবিক’। বদলি হয়েছেন এমন কিছু নার্সের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো প্রক্রিয়াটিই নিয়ন্ত্রণ করেছে একটি ‘সিন্ডিকেট’ এবং প্রায় প্রতিটি বদলির ক্ষেত্রে ঘটেছে ‘ঘুষ বাণিজ্য’। ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন, প্রতিটি বদলিতে দালালের শরণাপন্ন হতে বাধ্য করা হয়েছে তাদের এবং দিতে হয়েছে দুই লাখ ২০ হাজার থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। তাদের দাবি, প্রতিবাদ করলেই হয়রানির খড়গ নেমে আসায় তারা এই অনিয়ম মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, নার্সিং সেক্টরে বদলি বাণিজ্যের এই প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয় অধিদপ্তরের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ইন্ধনে তাদের মদতপুষ্ট লোকদের মাধ্যমে। বছরের পর বছর ধরে চলছে এমন অনিয়ম। তবে করোনার ভেতরে এই অনিয়ম হয়েছে সবচেয়ে বেশি এবং বদলি হতে ইচ্ছা পোষণ করা নার্সদের দিতে হয়েছে আগের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি অর্থ। 

ভোরের আকাশের নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নার্স বদলি বাণিজ্যে যুক্ত এক ব্যক্তির নাম মো. জামাল উদ্দিন। ওই অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার ‘আত্মীয়’ পরিচয় দিয়ে এই বদলি বাণিজ্য করে ভবঘুরে অবস্থা থেকে কোটিপতি বনে গেছেন তিনি। মো. জামাল উদ্দিন নামের একজনের ৮টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য এসেছে দৈনিক ভোরের আকাশের প্রতিবেদকদের হাতে। নার্সিং সেক্টরের কেউ না হয়েও ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া জামালের অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে কোটি কোটি টাকা। তার স্ত্রীর নামে করা একটি সঞ্চয়ী হিসাবে সাত মাসে জমা পড়েছে ৭২ লাখ টাকা।

বিভিন্ন সময় বদলিপ্রার্থী নার্সদের প্রতারিত হওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নার্স বদলি বাণিজ্যে মো. জামাল উদ্দিনের সংশ্লিষ্টতা অনুসন্ধানে মাঠে নামেন দৈনিক ভোরের আকাশ এর একটি চৌকস সাংবাদিক টিম। এই টিমের সদস্যদের হাতে মো. জামাল উদ্দিনের বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাব ও বিপুল অংকের অর্থ লেনদেনের প্রমাণও রয়েছে। পাশাপাশি এই টিমের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকা এবং কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলায় মো. জামালের দুধকুমড়া গ্রাম, তার বাড়ি ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ প্রত্যক্ষ করেছেন। তারা কথা বলেছেন মো. জামালউদ্দিন ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য এবং গ্রামবাসীর সঙ্গে।

নার্স নিয়োগ বাণিজ্যের অন্যতম হোতা জামাল উদ্দিন। কুষ্টিয়ায় জমি নিয়ে মারামারির ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় তোলা। (ছবি: ভোরের আকাশ)

 

কে এই জামাল উদ্দিন ?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে নার্স বদলির বাণিজ্যের ঘটনা ঘটছে বছরের পর বছর ধরে। এ অধিদপ্তরে শীর্ষ পদে যারা আসেন মূলত তাদের ঘিরেই চলে এই বদলি বাণিজ্য। এ দাবি অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য কর্মকর্তাদের। তাদের দাবি অনুযায়ী, এ অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বর্তমানে নার্সিংয়ের এসব বদলির তদবির করছেন। এদের অধিকাংশই অধিদপ্তরে চাকরিই করেন না। মো. জামাল উদ্দিন তাদেরই একজন। নিবিড় অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে জামাল উদ্দিনের পুরো পরিচয়। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কমলাপুরের দুধকুমড়া গ্রামে বাড়ি জামাল উদ্দিনের। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সনটেক এলাকার শহীদ তিতুমীর সড়কের ২০ নং হোল্ডিংয়ের বাসাটি তার বর্তমান ঠিকানা। ১৯৮৩ সালের ১৫ আগস্ট মো. জামাল উদ্দিনের জন্ম। তার স্ত্রীর নাম শাকিরুন নেছা। নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন জামাল।

জামালের নিজ গ্রাম দুধ কুমড়াবাসী জানায়, মো. জামাল উদ্দিনের পিতা মো. শাহজাহান আলী ও মাতা রোকেয়া খাতুন। তাদের দুই সন্তান মো. জামাল উদ্দিন ও মো. আবু জাফর। জামালের বাবা এলাকায় ‘ফুকারি’ হিসেবে বেশ পরিচিত। স্বাধীনতার আগে ডাকাতি ও চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত থাকার অপবাদও আছে তাদের পরিবারের। এজন্য এলাকার অনেকে তাদের পরিবারকে ‘ডাকাত পরিবার’ বলে কটাক্ষ করে থাকেন। ওই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নামের শেষে ‘বিশ্বাস’ উপাধি যুক্ত রয়েছে।

৬ষ্ঠ শ্রেণির বেশি লেখাপড়া করা হয়নি জামালের। কয়েক বছর আগেও ছিলেন ভবঘুরে। প্রতিবেশীরা তাদের অভাব-অনটনেই বড় হতে দেখেছেন। অভাবী সেই পরিবার এখন জামালের পাওয়া ‘আলাদিনের চেরাগ’ ঘষে হঠাৎ করেই ফুলে ফেঁপে উঠেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েকদিন আগে কুষ্টিয়া সদরে নিজ জমিতে বিল্ডিং নির্মাণকাজ কেন্দ্রিক মারামারির ঘটনায় মো. জামাল উদ্দিন আহত হয়েছেন।

জামালের সম্পদের পাহাড়

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের আশীর্বাদে নার্স বদলি বাণিজ্য করে জামাল গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। কুষ্টিয়া সদরের ইন্দিরা মোড়ে স্ত্রী শাকিরুন নেছা এর নামে কিনেছেন ৪ কাঠা জমি। এর দাম ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টাকা। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কমলাপুরের নিজ গ্রাম দুধকুমড়ায় প্রায় ২৭ থেকে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন একটি দোতলা আলিশান বাড়ি। এর পাশেই ‘বিশ^াস বাড়ী’ নামে আরেকটি একতলা পাকাবাড়ি নির্মাণেও বেশিরভাগ টাকা জামাল দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসী। তিনি ২০২১ সালের পহেলা জুলাই রাজধানীতে ‘ মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজ’ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেন। যাত্রাবাড়ীর শেখদী স্কুল রোডের ৩৭/২৩ নং হোল্ডিংয়ে গড়ে উঠা তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নং -ট্রেড/ডিএসসিসি/০২০৬৪৪২০২১। 

দৈনিক ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে তার আটটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয়টি এ্যাকাউন্টে ৫ কোটি ৫২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৬ লাখ টাকা জমা করার নথি পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সোনালী ব্যাংকের কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা কমপ্লেক্স শাখায় তার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ৩০১৬৩০১০১৩০৮১। বিশেষ কোন ব্যবসা না থাকলেও এই সঞ্চয়ী হিসাবটিতে সারা দেশ থেকেই টাকা জমা পড়ে। গত ২০২১ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসেই এই একটি হিসাবে ২১টি জেলার ৪৩টির বেশি শাখা থেকে ৬৩ বার টাকা জমা পড়েছে। ২০২১ সালের ২৬ জুলাই খোলা হলেও উল্লিখিত সময়ের মধ্যে অ্যাকাউন্টটিতে ১ কোটি ৩০ লাখ ৪৭ হাজার ১১৮ টাকার বেশি লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে এবং এই সময়ের মধ্যে এই অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করা হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ ৬৩ হাজার ৩৫৪ টাকা। সঞ্চিত রয়েছে ২০ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬৪ টাকা।

জামাল উদ্দিনের যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া শাখার কৃষি ব্যাংকে রয়েছে পৃথক আ্যাকাউন্ট। যার সঞ্চয়ী হিসাব ৪১২৩০৩১০০৫০৯৭০। এতে ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৭ লাখ ৮৮ হাজার ২২২ টাকা জমা পড়েছে এবং উত্তোলন করা হয়েছে ৩৭ লাখ ৫৫ লাখ ৬৩৯ টাকা।

 জামাল উদ্দিনের পৈত্রিক বাড়ি। বাড়ির নাম বিশ্বাস বাড়ি। গ্রামবাসীর দাবি আগে গরিব ছিলেন জামালরা।নিয়োগ বাণিজ্যে কোটিপতি হওয়ার পর এ বাড়িটিও তৈরি হয়েছে জামালের টাকায়। (ছবি: ভোরের আকাশ)

 

 

জামালের স্ত্রী শাকিরন নেছা পেশায় গৃহবধূ। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সোনালী ব্যাংক শাখায় শাকিরুন নেসার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ৩০১৬৩০১০১৩০১৯। এই অ্যাকাউন্টটি ২০২১ সালে ১৮ মে খোলা হয়। এই হিসাব নম্বরেও লেনদেন হয়েছে ৭২ লাখ ৮২ হাজার ৭১ টাকা। সেখান থেকে ৬৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৫ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি এ অ্যাকাউন্টে সঞ্চিতি ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ২১৬ টাকা।

জামালের আরেকটি অ্যাকাউন্ট আছে রাজধানীর শনির আখড়া শাখার কৃষি ব্যাংকে। যার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ১৯১৪০৩১১০৫৪৬৩৫। এখানে ২০২১ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ লক্ষাধিক টাকা জমা আছে জামালের।

ডাচ বাংলা ব্যাংকের দনিয়া শাখায় সূচনা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি অ্যাকাউন্ট আছে। এটিও জামাল উদ্দিনের অ্যাকাউন্ট। ১১৯১১০১৪৫০১ এই হিসাব নম্বরটিতে জমা পড়ে ২ কোটি ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭৩ টাকা। এই অ্যাকাউন্ট থেকে ২ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার ২২৫ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ডাচ বাংলা ব্যাংক শাখায় রয়েছে জামালের আরও একটি অ্যাকাউন্ট। ১৬৮১১০০০২২১০১ হিসাব নম্বরটিতে ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ লাখ ১০ হাজার ৯৪০ টাকা জমা পড়েছে।

 

বদলি বাণিজ্যের সিন্ডিকেট

ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মো. কমল নামে মো. জামাল উদ্দিনের এক চাচা আছেন। এলাকাবাসী জানান, কমল ঢাকায় নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন নারী কর্মকর্তাকে আত্মীয় বানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তাকে ধরেই বিত্তবান হয়েছেন মো. কমল। আর মো. কমল এর হাত ধরেই মো. জামাল উদ্দিনের এগিয়ে চলা।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে জানা গেছে, জামালের চাচা কমল বিয়ে করেছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। সেই দিক থেকে নার্সিং অধিদপ্তরের শীর্ষ ওই কর্মকর্তার সঙ্গে জামালের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি নিজেকে ওই কর্মকর্তার নাতি হিসেবে দাবি করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, জামাল নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে ওই কর্মকর্তার আত্মীয় পরিচয়ে বিশেষ সুবিধা আদায় করতেন। ওই কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতেও তার কক্ষে জামাল প্রবেশ করতেন এবং ওই কক্ষে বসেই বদলি প্রত্যাশী নার্সদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন এবং টাকা দাবি করতেন।

নাম প্রকাশে কয়েকজন নার্স নেতা বলেন, ‘সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলেও আমরা এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করতে পারি না। প্রতিবাদ করলেই বিভাগীয় মামলাসহ বিভিন্ন হয়রানি হতে হয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এই তিন মাসে অন্তত চার হাজারের বেশি নার্স বদলি হয়েছে। এর বেশিরভাগ বদলিতেই ঘটেছে আর্থিক লেনদেন এবং অধিকাংশই মধ্যস্থতা করেছেন জামাল।’

ওই নার্সদের ধারণা, বছরের মাত্র তিন মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত একটি অধিদপ্তরে অস্বাভাবিক এমন বদলির ঘটনায় অন্তত ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। তাদের দাবি, জামালকে গ্রেফতার করে এই অনিয়মের তদন্ত করলেই এর পেছনে যারা আছে তাদের পরিচয় বের হয়ে আসবে। তারা দাবি করেন, বছরের পর বছর ধরে নার্স বদলিতে এ ধরনের আর্থিক লেনদেন যেন বন্ধ করা হয়। এ বিষয়ে প্রশাসনকে কার্যকরী তদন্ত করে জড়িত নেপথ্য কুশীলবদের খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখি করার দাবি করেন তারা।

কয়েকজন নার্স বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে সরকার গঠনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে মর্যাদা পেয়েছেন নার্সরা। তিনি নার্সদের যথাযথ সম্মান দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতায় আসার পর পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে নার্সদের দিয়েছেন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা। এই মহামারির সময়ে ‘করোনা যোদ্ধা’ নার্সরাই রোগীদের সেবা দিয়ে হাসপাতালে সার্বক্ষণিক তাদের পাশে থাকেন। স্বল্প বেতনের এই নার্সরাই বদলি হতে চাইলে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার ইশারায় বারেবারে তাদের ওপর নেমে আসছে খড়গ। সরকারি চাকরিতে বদলি স্বাভাবিক নিয়ম হলেও ঘুষ না দিলে কোথাও পোস্টিং পান না তারা। এসব অনিয়ম অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

 কুষ্টিয়ায় জামাল উদ্দিনের নিজের বাড়ি। (ছবি: ভোরের আকাশ)

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অতিরিক্ত সচিবও জানিয়েছেন এক নার্সের বদলির অনুরোধ জানাতে গিয়ে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তিনি জানান, ‘আমি নিজে তদবির করেছি বদলির জন্য, কিন্তু হয়নি। বাধ্য হয়ে সে (ওই নার্স) তিন মাস পরে টাকা দিয়ে বদলি হয়ে এসে আমাকে বলেছে, স্যার আপনি তো পারলেন না। আমি টাকা দিয়ে ট্রান্সফার অর্ডার করিয়ে এসেছি।’ মোট কথা টাকা ছাড়া নার্সিংয়ে বদলির ঘটনা প্রায় ঘটেই না।

ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রতিটি বদলিতে নার্সিংয়ের ওই শীর্ষ কর্মকর্তার নামে তাদের দিতে হয়েছে জন প্রতি দুই লাখ টাকা। এই টাকা নিয়েছেন জামাল। এর পর তাকেও দিতে হত বখরা। ফলে প্রতিটি বদলির জন্য তাকেও ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা উৎকোচ দিতে হত মধ্যস্থতার বিনিময়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, নিজের পছন্দের হাসপাতালে বদলির জন্য তাদের ২ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। আর বিশেষ হাসপাতালে বদলির ক্ষেত্রে জামাল উৎকোচ নিতেন সাড়ে তিন লাখ টাকা। শুধু জামাল নন; বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেকেই এভাবে আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে জানান, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং নভেম্বর এই তিন মাসে অন্তত চার হাজারের বেশি নার্স বদলি হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘটেছে এই বদলি বাণিজ্য। তবে বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় পরবর্তী দুই মাসে বদলির সংখ্যা কমে গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে বদলির আদেশ হয়েছে প্রায় ১০০ জন নার্সের। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুই মাসে বদলির আদেশ হচ্ছে যাদের, অভিযোগ রয়েছে তাদের বেশিরভাগের কাছ থেকেও ইতোপূর্বে নেওয়া হয়েছে উৎকোচ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু জামাল নয়; নার্স বদলি নিয়ে সারাদেশে এই সিন্ডিকেট আছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ময়মনসিংহ-সিলেটের বদলির তদবির করেন দুই জন। এদের একজন বাংলাদেশ নার্সিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) সিলেট শাখার নেতা এবং আরেকজন এক নার্সিং কর্মর্কতার ভাই; যিনি ময়মনসিংহ এলাকার একটি পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। বিএনএর ওই নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। তিনি সিলেটে বসে ঢাকায় নার্সিং অধিদপ্তরের ইমেজ ভালো করার জন্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রচারেরও তদবির করে থাকেন।

বদলি বাণিজ্যে আবার রয়েছে সেক্টর ভাগ। দেশের একেক জেলা ও এলাকা রয়েছে একেক দালালের দখলে। এরমধ্যে বৃহত্তর কুমিল্লা এলাকা যার দালালিপনার আওতায় তার নামের আদ্যক্ষর ‘জ’। খুলনা যার আওতায় তিনি একজন নারী। তার নামের আদ্যক্ষর ‘আ’। রংপুর রাজশাহী ডিল করেন যারা তাদের নামের আদ্যক্ষর যথাক্রমে ‘না’ এবং ‘আ’। ঢাকা বিভাগে নার্সদের বদলির বিষয়টি দেখভাল করেন দুই জন। যাদের নামের আদ্যক্ষর যথাক্রমে ‘অ’ এবং ‘নে’। বরিশালে নার্স বদলির মধ্যস্থতা করেন দুইজন। এদের মধ্যে এক কর্মকর্তা সদ্য অবসরের প্রস্তুতিজনিত ছুটিতে গেছেন। অপরজনে আদ্যক্ষর ‘সা’। ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট এই সব এলাকায় বদলি বাণিজ্যের হোত একজন গাড়িচালক। আর রাজধানীতে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে সারাদেশের হোতাদের কাজ সমন্বয় করতেন ওই অধিদপ্তরের এক নারী ও এক পুরুষ কর্মকর্তা। তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা দুজনেই এরইমধ্যে লন্ডনে চলে গেছেন। আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ার পরেও তাদের বিদেশে নিজ খরচে পড়তে যাওয়ার এই তথ্য বিস্মিত করেছে অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তাসহ নার্সদের। তাদের প্রশ্ন, এত টাকা তারা কোথায় পেলেন? 

স্ত্রীর নামে কুষ্টিয়া শহরে কেনা জামালের জমি।

 

বদলি নিয়ে জামালের এক কথোপকথনের একটি কল রেকর্ড এসেছে ভোরের আকাশের হাতে। তাতে একজন নার্স জানতে চাইছেন বলছেন, ‘দিনাজপুর মেডিক্যালে কি পোস্ট আছে?’ জামাল বলেন, ‘আমার জানামতে আছে। সমস্যা নেই, তুমি টেনশন করো না। ব্যবস্থা করবোনে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বছরের ৩ আগস্ট  ‘ক’ আদ্যক্ষরের এক নার্স বদলির আদেশ পান। এরপরই তিনি সোনালী ব্যাংকের নাজিমউদ্দিন রোড শাখা থেকে ২০২১ সালের ৫ আগস্ট মো. জামাল উদ্দিনের হিসাব নম্বরে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা দেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি হন ‘স’ আদ্যক্ষরের এক নার্স। ২০২১ সালের ৯ আগস্ট সোনালী ব্যাংকের নাজিমউদ্দিন রোড শাখা থেকে মো. জামাল উদ্দিনের হিসাবে তিনি ২ লাখ টাকা জমা দেন। টাকা দেওয়ার ১০ দিনের মাথায় ২৩ আগস্ট তার বদলির আদেশ হয়।

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি হন ‘আ’ আদ্যক্ষরের এক নার্স। ২০২১ সালের ৯ আগস্ট সোনালী ব্যাংকের নাজিমউদ্দিন রোড শাখা থেকে মো. জামাল উদ্দিনের হিসাবে ২০ হাজার টাকা জমা দেন। তার বদলির আদেশ হয় ১৫ সেপ্টেম্বর। তার লেনদেন করা বাকি টাকার তথ্য অবশ্য জানা সম্ভব হয়নি।

এমন অনেকগুলো নথি হাতে এসেছে ভোরের আকাশের প্রতিবেদকের। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন নার্সের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয় ভোরের আকাশের পক্ষ থেকে। তারা এসব তথ্য স্বীকার করে কেঁদে বলেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করেও সফল হননি তারা। জামাল তাদের বলেছেন টাকা ছাড়া বদলি হবে না। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়েই বদলির আদেশ করিয়েছেন তারা।

 

টাকা নিয়ে ফেরত

নার্সিং নিয়ে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠার পর কয়েকজনের টাকাও ফেরত দিয়েছে জামাল উদ্দিন।

২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর মহাখালি ব্রাঞ্চ থেকে আইএফআইসি ব্যাংকের দনিয়া ব্রাঞ্চে মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজ নামের ০১৯০২৯২৫৯৫০০১ হিসেব নম্বরে এক লাখ টাকা পাঠান একজন।

কী কারণে এই অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোবাইলে এ বিষয়ে কথা বলবো না, আমি এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলবো। বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) আমার সকাল ডিউটি। আপনি ফোন দিয়ে এসেন। সাক্ষাতে কথা বলবো।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনি টাকা দিয়েছিলেন তার আত্মীয় এক নার্সের (আদ্যক্ষর ‘স’) বদলির জন্য। তবে এই বদলির কাজ করতে পারেননি জামাল। সে কারণে চাপ দেওয়ায় জামাল ওই টাকা ফেরত দিয়েছে।

এমন আরেকটি ঘটনা পাওয়া গেছে ‘রো’ আদ্যক্ষরের এক নার্সের ক্ষেত্রেও। তার কিছু টাকা ফেরত গেছে হাফিজ আল আসাদের ডাচ বাংলা ব্যাংকের সিরাজগঞ্জ শাখার অ্যাকাউন্টে ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জামাল এসব কাজে ০১৯৩৮৭৩১৬৭৬ এই নম্বরটি ব্যবহার করতেন। তবে এটি তার নামে রেজিস্ট্রিশন করা নয়। বদলি সংক্রান্ত সব ধরনের কাজে কথোপকথন এই নম্বর থেকেই করতেন তিনি। তবে বর্তমানে নম্বরটি বন্ধ রয়েছে। তিনি ০১৭১৬৩৯০৯৫৭ নম্বরের আরেকটি মোবাইল নম্বরও ব্যবহার করেন; সেটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।

একটি সূত্র দাবি করেছে, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এই হিসাব নম্বর গুলোর লেনদেন দেখলে জামালের অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যের সব তথ্য পাওয়া যাবে। যার দৃশ্যমান কোনো আয় নেই তার অ্যাকাউন্টে কিভাবে কোটি কোটি টাকা এলো তা অবশ্যই তদন্ত করা উচিত।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে এমন আলোচিত বদলি বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে জানতে মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তারকে একাধিকবার ফোন করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি।

মন্তব্য

Beta version