-->
শিরোনাম
নার্স বদলি বাণিজ্যের হোতা

কে এই জামাল উদ্দিন?

নিজস্ব প্রতিবেদক
কে এই জামাল উদ্দিন?
কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নার্স বদলি বাণিজ্যের অন্যতম হোতা মো. জামাল উদ্দিন (২৫ জানুয়ারির ছবি)

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর--এই তিন মাসে চার হাজার নার্সে র বদলির যে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে তার প্রায় প্রতিটির পেছনে জড়িত ছিল ঘুষ লেনদেন। ঘটনার শিকার নার্সদের দাবি এই বদলি বাণিজ্যের হোতাদের অন্যতম হচ্ছেন মো. জামাল উদ্দিন। তার হাত দিয়ে ঘটেছে বেশিরভাগ লেনদেন যার সঙ্গে জড়িত এই অধিদপ্তরের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। এভাবে ওই তিন মাসে নার্স  বদলির বাণিজ্য করে ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকার ঘুষ গ্রহণ করা হয়েছে। ওই অধিদপ্তরের পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের দাবি, কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার আশীর্বাদে নিয়োগ বাণিজ্যের তদবির করে হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে এক শীর্ষ  কর্মকর্তার ‘নাতি’ পরিচয়ধারী এই জামাল উদ্দিন।

ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে নার্স বদলির বাণিজ্যের ঘটনা ঘটছে বছরের পর বছর ধরে। এ অধিদপ্তরে শীর্ষ পদে যারা আসেন, মূলত তাদের ঘিরেই চলে এ বদলি-বাণিজ্য। এ দাবি অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য কর্মকর্তাদের।

তাদের দাবি অনুযায়ী, এ অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বর্তমানে নার্সিংয়ের এসব বদলির তদবির করছেন। এদের অধিকাংশই অধিদপ্তরে চাকরিই করেন না। মো. জামাল উদ্দিন তাদেরই একজন। নিবিড় অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে জামাল উদ্দিনের পুরো পরিচয়। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কমলাপুরের দুধকুমড়া গ্রামে বাড়ি জামাল উদ্দিনের। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সনটেক এলাকার শহীদ তিতুমীর সড়কের ২০নং হোল্ডিংয়ের বাসাটি তার বর্তমান ঠিকানা। ১৯৮৩ সালের ১৫ আগস্ট মো. জামাল উদ্দিনের জন্ম। তার স্ত্রীর নাম শাকিরুন নেছা। নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন জামাল।

জামালের নিজ গ্রাম দুধ কুমড়াবাসী জানায়, মো. জামাল উদ্দিনের পিতা মো. শাহজাহান আলী ও মাতা রোকেয়া খাতুন। তাদের দুই সন্তান মো. জামাল উদ্দিন ও মো. আবু জাফর। জামালের বাবা এলাকায় ‘ফুকারি’ হিসেবে বেশ পরিচিত। স্বাধীনতার আগে ডাকাতি ও চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত থাকার অপবাদও আছে তাদের পরিবারের। এজন্য এলাকার অনেকে তাদের পরিবারকে ‘ডাকাত পরিবার’ বলে কটাক্ষ করে থাকেন। ওই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নামের শেষে ‘বিশ্বাস’ উপাধি যুক্ত রয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি লেখাপড়া করা হয়নি জামালের। কয়েক বছর আগেও ছিলেন ভবঘুরে। প্রতিবেশীরা তাদের অভাব-অনটনেই বড় হতে দেখেছেন। অভাবী সেই পরিবার এখন জামালের পাওয়া ‘আলাদিনের চেরাগ’ ঘষে হঠাৎ করেই ফুলে ফেঁপে উঠেছে।

ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মো. কমল নামে মো. জামাল উদ্দিনের এক চাচা আছেন। এলাকাবাসী জানান, কমল ঢাকায় নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন নারী কর্মকর্তাকে আত্মীয় বানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তাকে ধরেই বিত্তবান হয়েছেন মো. কমল। আর মো. কমল এর হাত ধরেই মো. জামাল উদ্দিনের এগিয়ে চলা।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে জানা গেছে, জামালের চাচা কমল বিয়ে করেছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। সেই দিক থেকে নার্সিং অধিদপ্তরের শীর্ষ ওই কর্মকর্তার সঙ্গে জামালের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি নিজেকে ওই কর্মকর্তার নাতি হিসেবে দাবি করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, জামাল নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে ওই কর্মকর্তার আত্মীয় পরিচয়ে বিশেষ সুবিধা আদায় করতেন। ওই কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতেও তার কক্ষে জামাল প্রবেশ করতেন এবং ওই কক্ষে বসেই বদলি প্রত্যাশী নার্সদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন এবং টাকা দাবি করতেন।

নাম প্রকাশে কয়েকজন নার্স নেতা বলেন, ‘সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলেও আমরা এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করতে পারি না। প্রতিবাদ করলেই বিভাগীয় মামলাসহ বিভিন্ন হয়রানি হতে হয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এই তিন মাসে অন্তত চার হাজারের বেশি নার্স বদলি হয়েছে। এর বেশিরভাগ বদলিতেই ঘটেছে আর্থিক লেনদেন এবং অধিকাংশই মধ্যস্থতা করেছেন জামাল।’

ওই নার্সদের ধারণা, বছরের মাত্র তিন মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত একটি অধিদপ্তরে অস্বাভাবিক এমন বদলির ঘটনায় অন্তত ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। তাদের দাবি, জামালকে গ্রেফতার করে এই অনিয়মের তদন্ত করলেই এর পেছনে যারা আছে তাদের পরিচয় বের হয়ে আসবে। তারা দাবি করেন, বছরের পর বছর ধরে নার্স বদলিতে এ ধরনের আর্থিক লেনদেন যেন বন্ধ করা হয়। এ বিষয়ে প্রশাসনকে কার্যকরী তদন্ত করে জড়িত নেপথ্য কুশীলবদের খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখি করার দাবি করেন তারা।

কয়েকজন নার্স বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে সরকার গঠনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে মর্যাদা পেয়েছেন নার্সরা। তিনি নার্সদের যথাযথ সম্মান দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতায় আসার পর পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে নার্সদের দিয়েছেন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা। এই মহামারির সময়ে ‘করোনা যোদ্ধা’ নার্সরাই রোগীদের সেবা দিয়ে হাসপাতালে সার্বক্ষণিক তাদের পাশে থাকেন। স্বল্প বেতনের এই নার্সরাই বদলি হতে চাইলে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার ইশারায় বারেবারে তাদের ওপর নেমে আসছে খড়গ। সরকারি চাকরিতে বদলি স্বাভাবিক নিয়ম হলেও ঘুষ না দিলে কোথাও পোস্টিং পান না তারা। এসব অনিয়ম অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত মাসে কুষ্টিয়া সদরে নিজ জমিতে বিল্ডিং নির্মাণকাজকেন্দ্রিক মারামারির ঘটনায় মো. জামাল উদ্দিন আহত হয়েছেন। এরপর ভর্তি  হন কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে। এ বিষয়ে থানায় এজাহারও দায়ের করেছেন তার ভাই, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে জামালের কেনা জমির কথাও।

জামালের সম্পদের ব্যাপারে তার সঙ্গে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে কথা হয় ভোরের আকাশ প্রতিবেদকের। নার্স বদলি বাণিজ্যে তার সম্পৃক্ততা এবং ভবঘুরে থেকে কোটিপতি হওয়ার বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে জামাল বলেন, ‘আমার অবস্থা ভালো না। শরীরে অনেক আঘাত পেয়েছি। এমন অবস্থায় আমি মিথ্যা কথা বলব না। সত্য বলতে কী, নার্স বদলি বাণিজ্যে আমি জড়িত নই। আমি ছোট খাটো ব্যবসা করি।’

তার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা ছড়ানো হচ্ছে বলেও দাবি করেন মো. জামাল উদ্দিন। 

মন্তব্য

Beta version