-->
শিরোনাম

নার্সদের বদলি সিন্ডিকেন্টের হাতে

নিজস্ব প্রতিবেদক
নার্সদের বদলি সিন্ডিকেন্টের হাতে

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে নার্সদের বদলির ক্ষেত্রে আগে থেকেই ‘বদলি বাণিজ্যের’ অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী নার্সরা দাবি করেন, এ অধিদপ্তরের শীর্ষ পদগুলোতে আসা কর্মকর্তাদের ইশারাতেই ঘটে বদলি বাণিজ্য, গড়ে ওঠে পছন্দের সিন্ডিকেট। বরং প্রতিবছরই বাড়ে বদলি বাণিজ্যের হোতাদের টাকা দাবির পরিমাণ। এতে ব্যবহার করা হয় শীর্ষ কর্মকর্তাদের নাম। টাকার লেনদেনও করেন তাদের পছন্দের লোক। জামাল উদ্দিন হচ্ছেন এক কর্মকর্তার তেমনই পছন্দের ব্যক্তি।

নার্স বদলি বাণিজ্যের অন্যতম হোতা মো. জামাল উদ্দিন। জমি নিয়ে মারামারিতে আহত হয়ে কুষ্টিয়া হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ২৫ জানুয়ারি তোলা ছবি।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রতিটি বদলিতে নার্সিংয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তার নামে তাদের দিতে হয়েছে জনপ্রতি ২ লাখ টাকা। এ টাকা নিয়েছেন জামাল। এরপর তাকেও দিতে হত বখরা। ফলে প্রতিটি বদলির জন্য তাকেও ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা উৎকোচ দিতে হত মধ্যস্থতার বিনিময়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীরা জানান, নিজের পছন্দের হাসপাতালে বদলির জন্য তাদের ২ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। আর বিশেষ হাসপাতালে বদলির ক্ষেত্রে জামাল উৎকোচ নিতেন সাড়ে ৩ লাখ টাকা। শুধু জামাল নন; বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেকেই এভাবে আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে জানান, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর- এ তিন মাসে অন্তত ৪ হাজারের বেশি নার্স বদলি হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘটেছে এ বদলি-বাণিজ্য। তবে বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় পরবর্তী দুই মাসে বদলির সংখ্যা কমে গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে বদলির আদেশ হয়েছে প্রায় ১০০ জন নার্সের।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দুই মাসে বদলির আদেশ হচ্ছে যাদের, অভিযোগ রয়েছে তাদের বেশিরভাগের কাছ থেকেও ইতোপূর্বে নেওয়া হয়েছে উৎকোচ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু জামাল নয়; নার্স বদলি নিয়ে সারা দেশে এ সিন্ডিকেট আছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ময়মনসিংহ-সিলেটের বদলির তদবির করেন দুজন। এদের একজন বাংলাদেশ নার্সিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) সিলেট শাখার নেতা এবং আরেকজন এক নার্সিং কর্মর্কতার ভাই; যিনি ময়মনসিংহ এলাকার একটি পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। বিএনএর ওই নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। তিনি সিলেটে বসে ঢাকায় নার্সিং অধিদপ্তরের ইমেজ ভালো করার জন্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রচারেরও তদবির করে থাকেন।

বদলি-বাণিজ্যে আবার রয়েছে সেক্টর ভাগ। দেশের একেক জেলা ও এলাকা রয়েছে একেক দালালের দখলে। এর মধ্যে বৃহত্তর কুমিল্লা এলাকা যার দালালিপনার আওতায় তার নামের আদ্যক্ষর ‘জ’। খুলনা যার আওতায় তিনি একজন নারী । তার নামের আদ্যক্ষর ‘আ’। রংপুর রাজশাহী ডিল করেন যারা তাদের নামের আদ্যক্ষর যথাক্রমে ‘না’ এবং ‘আ’। ঢাকা বিভাগে নার্সদের বদলির বিষয়টি দেখভাল করেন দুজন। যাদের নামের আদ্যক্ষর যথাক্রমে ‘অ’ এবং ‘নে’। বরিশালে নার্স বদলির মধ্যস্থতা করেন দুজন। এদের মধ্যে এক কর্মকর্তা সদ্য অবসরের প্রস্তুতিজনিত ছুটিতে গেছেন। অপরজনে আদ্যক্ষর ‘সা’। ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট এসব এলাকায় বদলি-বাণিজ্যের হোতা একজন গাড়িচালক। আর রাজধানীতে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে সারা দেশের হোতাদের কাজ সমন্বয় করতেন ওই অধিদপ্তরের এক নারী ও এক পুরুষ কর্মকর্তা। তবে অধিদপ্তরের যে দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা দুজনেই এরই মধ্যে লন্ডনে চলে গেছেন। আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ার পরেও তাদের বিদেশে নিজ খরচে পড়তে যাওয়ার এ তথ্য বিস্মিত করেছে অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তাসহ নার্সদের। তাদের প্রশ্ন, এত টাকা তারা কোথায় পেলেন?

বদলি নিয়ে জামালের এক কথোপকথনের একটি কল রেকর্ড এসেছে ভোরের আকাশের হাতে। তাতে একজন নার্স জানতে চাইছেন বলছেন, ‘দিনাজপুর মেডিকেলে কি পোস্ট আছে?’ জামাল বলেন, ‘আমার জানামতে আছে। সমস্যা নেই, তুমি টেনশন করো না। ব্যবস্থা করবোনে।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বছরের ৩ আগস্ট ‘ক’ আদ্যক্ষরের এক নার্স বদলির আদেশ পান। এরপরই তিনি সোনালী ব্যাংকের নাজিমউদ্দিন রোড শাখা থেকে ২০২১ সালের ৫ আগস্ট মো. জামাল উদ্দিনের হিসাব নম্বরে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা দেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি হন ‘স’ আদ্যক্ষরের এক নার্স। ২০২১ সালের ৯ আগস্ট সোনালী ব্যাংকের নাজিমউদ্দিন রোড শাখা থেকে মো. জামাল উদ্দিনের হিসাবে তিনি ২ লাখ টাকা জমা দেন। টাকা দেওয়ার ১০ দিনের মাথায় ২৩ আগস্ট তার বদলির আদেশ হয়।

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি হন ‘আ’ আদ্যক্ষরের এক নার্স। ২০২১ সালের ৯ আগস্ট সোনালী ব্যাংকের নাজিমউদ্দিন রোড শাখা থেকে মো. জামাল উদ্দিনের হিসাবে ২০ হাজার টাকা জমা দেন। তার বদলির আদেশ হয় ১৫ সেপ্টেম্বর। তার লেনদেন করা বাকি টাকার তথ্য অবশ্য জানা সম্ভব হয়নি। এমন অনেকগুলো নথি হাতে এসেছে ভোরের আকাশের প্রতিবেদকের। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন নার্সের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয় ভোরের আকাশের পক্ষ থেকে। তারা এসব তথ্য স্বীকার করে কেঁদে বলেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করেও সফল হননি তারা। জামাল তাদের বলেছেন টাকা ছাড়া বদলি হবে না। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়েই বদলির আদেশ করিয়েছেন তারা।

টাকা নিয়ে ফেরত

নার্সিং নিয়ে বদলি-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠার পর কয়েকজনের টাকাও ফেরত দিয়েছে জামাল উদ্দিন।

২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর মহাখালী ব্রাঞ্চ থেকে আইএফআইসি ব্যাংকের দনিয়া ব্রাঞ্চে মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজ নামের ০১৯০২৯২৫৯৫০০১ হিসেব নম্বরে ১ লাখ টাকা পাঠান একজন। কী কারণে এ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোবাইলে এ বিষয়ে কথা বলব না, আমি এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলব। গত বৃহস্পতিবার আমার সকাল ডিউটি। আপনি ফোন দিয়ে এসেন। সাক্ষাতে কথা বলব।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনি টাকা দিয়েছিলেন তার আত্মীয় এক নার্সের (আদ্যক্ষর ‘স’) বদলির জন্য। তবে এ বদলির কাজ করতে পারেননি জামাল। সে কারণে চাপ দেওয়ায় জামাল ওই টাকা ফেরত দিয়েছে।

এমন আরেকটি ঘটনা পাওয়া গেছে ‘রো’ আদ্যক্ষরের এক নার্সের ক্ষেত্রেও। তার কিছু টাকা ফেরত গেছে হাফিজ আল আসাদের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সিরাজগঞ্জ শাখার অ্যাকাউন্টে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জামাল এসব কাজে ০১৯৩৮৭৩১৬৭৬ এ নম্বর ব্যবহার করতেন। তবে এটি তার নামে রেজিস্ট্রিশন করা নয়। বদলি সংক্রান্ত সব ধরনের কাজে কথোপকথন এ নম্বর থেকেই করতেন তিনি। তবে বর্তমানে নম্বরটি বন্ধ রয়েছে। তিনি ০১৭১৬৩৯০৯৫৭ নম্বরের আরেকটি মোবাইল নম্বরও ব্যবহার করেন; সেটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। একটি সূত্র দাবি করেছে, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এ হিসাব নম্বরগুলোর লেনদেন দেখলে জামালের অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যের সব তথ্য পাওয়া যাবে। যার দৃশ্যমান কোনো আয় নেই তার অ্যাকাউন্টে কীভাবে কোটি কোটি টাকা এলো তা অবশ্যই তদন্ত করা উচিত।

তবে এর আগে গত জানুয়ারি মাসে কুষ্টিয়া শহরে তার জমির দখল নিয়ে একটি মারামারির ঘটনায় আহত হয়ে জেলা সদর হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন জামাল উদ্দিন। গত ২৫ জানুয়ারি ওই হাসপাতালে ভোরের আকাশ প্রতিবেদক তার সঙ্গে দেখা করে নার্স বদলি বাণিজ্যে জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চান। সেসময়ে জামাল বলেছেন, ‘আমার অবস্থা ভালো না। শরীরে অনেক আঘাত পেয়েছি। এমন অবস্থায় আমি মিথ্যা কথা বলব না। সত্য বলতে কী, নার্স বদলি বাণিজ্যে আমি জড়িত নই। আমি ছোট খাটো ব্যবসা করি। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা ছড়ানো হচ্ছে।’ পরে তার ফোন নম্বরে একাধিকবার চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে এমন আলোচিত বদলি বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে জানতে মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তারকে একাধিকবার ফোন করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি।

মন্তব্য

Beta version