-->

দলিপাড়া ভূমি অফিস: দালালরা হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা

ইদ্রিস আলম
দলিপাড়া ভূমি অফিস: দালালরা হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা

অফিসে কর্মকর্তাদের পাশে বসে চেয়ার-টেবিল পেতে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া ওরা কারা! এদের হাতেই দেওয়া হয় গ্রাহকের কোটি কোটি টাকার সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। এই দালালচক্রের মাধ্যম ছাড়া কোনো কাগজ যায় না কর্মকর্তাদের টেবিলে।

বলছি, রাজধানীর উত্তরার ক্যান্টনমেন্ট সার্কেলের বর্তমান দলিপাড়া ভূমি অফিসের দালালচক্রের কথা। এদের দেখলে মনে হবে’ এরাই ভ‚মি অফিসের কর্মকর্তা-কিংবা কর্মচারী। কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, এরা বহিরাগত। গ্রাহকদের জিম্মি করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এদের বিরুদ্ধে।

নাম-পরিচয় গোপন রেখে এই প্রতিবেদক রাজধানীর উত্তরার ক্যান্টনমেন্ট সার্কেলের (বর্তমান দলিপাড়া অফিস) ভূমি সহকারী কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে এই অভিযোগের সত্যতা পান। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কীভাবে গ্রাহকদের জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্রটি। দিন শেষে এই টাকার ভাগ যাচ্ছে কোথায়?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভূমি অফিসের একজন বলেন, আসলে কর্মকর্তাদের পাশের চেয়ারে যাদের টাকা নিতে দেখছেন, এরা কেউই ভূমি অফিসের কর্মচারী নয়। ওরা যে টাকা নিচ্ছে, এই টাকার ভাগ দিন শেষে এখানকার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটে যায়।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কীভাবে টাকা নিচ্ছে এই চক্র। দেখা যায়, প্রত্যেক স্বাক্ষরের জন্য গ্রাহকদের গুণতে হচ্ছে এক থেকে দুই হাজার টাকা। অফিসের কর্মকর্তারা নয়, সব সেবা নিয়ন্ত্রণ করছে ওই দালালরাই।সূত্র বলছে, উত্তরা ভূমি অফিসে গ্রাহকদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। তবে তাদের হাতে নেই অফিসের নিয়ন্ত্রণ। আর সব সেবাই সম্পন্ন হচ্ছে দালালদের ইশারায়।অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কর্মকর্তাদের মতোই অফিসের চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করে কাজ করছে দালালরা।

গুরুত্বপূর্ণ নথি, সরকারি আসবাবপত্র সবই থাকছে তাদের নিয়ন্ত্রণে। নামজারি করতে সরকারি খরচ লাগে এক হাজার ১৫০ টাকা। কিন্তু দালালরা দাবি করেন ১২ হাজার টাকা। ১২০ টাকার খাজনা-খারিজের জন্য গুণতে হয় দুই হাজার টাকা।

ভূমি অফিসে বহিরাগতদের এসব কাজের চিত্র ধারণ করা হয় গোপন ক্যামেরায়। গোপন ক্যামেরার ভিডিওতে দেখা যায়, সহকারী ভূমি কর্মকর্তার পাশের টেবিলে বসে দিব্যি দাপ্তরিক কাজ করছেন বহিরাগত বাবুসহ আরো কয়েকজন দালাল। এই দালালরা প্রকাশ্যেই গ্রাহকের কাছ থেকে সেবার নামে হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা।

অনুসন্ধানে আরো বেরিয়ে এসেছে ভারপ্রাপ্ত ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা কৃষ্ণা মণ্ডল, অফিস সহায়ক নাজমুল হাই সনি ও চেইনম্যান উত্তম কুমার হালদার সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও এখানে রয়েছে তাদের ব্যক্তিগতভাবে নিয়োগ দেওয়া ডজনখানেক দালাল।

এই অফিসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজগুলো সম্পাদন করেন বহিরাগত দালালরাই। শুধু স্বাক্ষর করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দালালদের ইশারা ছাড়া কোনো ফাইলেই স্বাক্ষর হয় না। এই অফিসে রয়েছে বাবু, রাজিবসহ ডজনখানেক দালাল।

আরো জানা গেছে, জমির নাম খারিজ ও খাজনার জন্য দুই হাজার থেকে শুরু করে ১২ হাজার পর্যন্ত বাড়তি টাকা গুনতে হয় সেবা গ্রহীতাদের। যাদের টাকা দিয়ে পেছনে পেছনে ঘুরছেন তারা যে শুধুই দালাল, তা জানেন না অনেক ভুক্তভোগী গ্রাহকও।

দালালরা যেভাবে গ্রাহকদের জিম্মি করেন

জানা যায়, অফিসের প্রতিটি কক্ষের জন্য রয়েছে ভেতরে-বাইরে আলাদা দালালচক্র। কারো কাজ রুমের ভেতরে, কারো কাজ অফিস রুমের বাইরে। এদের কাজ সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের ভুলভাল বুঝিয়ে কাগজপত্র নিজেদের দখলে নেওয়া। এরপর নানারকম কাজের কথা বলে শুরু হয় দর-কষাকষি। এই দালালদের দুই ভাগে দিতে হয় টাকা। কাগজ হাতে নেওয়ার পরই গুনতে হয় অগ্রিম টাকা। এরপর কাজ শেষে দিতে হয় বাকি টাকা। এখানেই শেষ নয়, চুক্তির পরও তৈরি হয় নানা জটিলতা এবং তার জন্য দিতে হয় আলাদা টাকা।

এদিকে, সেবা গ্রহীতারা বলছেন, কোনো প্রকার সরকারি নিয়োগ ছাড়া এমন গুরুত্বপূর্ণ অফিসে কী করে চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করছে দালালরা?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, খাজনা-খারিজ করতে ১২ হাজার টাকা চেয়েছেন দালাল বাবু। শুধু তাই নয়, কাজ শেষে মিষ্টি খেতে দিতে হবে আরো দুই হাজার টাকা। বাবু ছাড়া নাকি এই কাজ কেউ করাতেও পারবেন না।

এদিকে নিজেকে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়েও ঘুষের হাত থেকে রক্ষা পাননি ফারহানা ইয়াসমিন মিতু। তাকেও ঘুষের টাকা দিতে হয়েছে।

ভুক্তভোগী এ সরকারি কর্মকর্তা বলেন, নামজারি বাবদ ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হবে বলে জানিয়েছেন দালাল বাবু। ৫০০ টাকা দিলে মিষ্টি খেতে আরো দুই হাজার টাকা দাবি করেন এ দালাল। তিনি আরো বলেন, বহিরাগত দালালরা অফিসের ভেতরে এমনভাবে চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করছে যে, কারোরই বোঝার উপায় নেই- কে কর্মকর্তা আর কে বহিরাগত দালাল।

দালাল বাবুর কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি নিজেকে ভূমি অফিসের বহিরাগত দালাল হিসেবেই পরিচয় দেন। মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা জানতে চাইলে প্রথমে অস্বীকার করেন। পরে লেনদেনের ভিডিও দেখালে চুপসে যান দালাল বাবু। পরে নানাভাবে বিষয়টি আপসের চেষ্টা শুরু করেন ওই দালাল। এরই মধ্যে নিজ চেয়ার থেকে সটকে পড়েন অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ক্যান্টনমেন্ট জোনের সহকারী কমিশনার (অ্যাসিল্যান্ড) শাহরিয়ার রহমান বলেন, ‘মাত্র শুনলাম আপনার কাছ থেকে। এ সম্পর্কে তেমন জানি না। যদি বহিরাগত দালালদের দিয়ে কার্যক্রম চলে আমি অব্যশই ব্যবস্থা নেব।’

একজন কর্মকর্তার পাশে চেয়ার-টেবিল বসিয়ে কী করে দালালরা কাজ করতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। এমন অপরাধ যারা করবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মন্তব্য

Beta version