-->
শিরোনাম

বেড়েই চলছে পরিচয়হীন নবজাতক

ইদ্রিস আলম
বেড়েই চলছে পরিচয়হীন নবজাতক

সম্প্রতি উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলছে জীবিত কিংবা মৃত নবজাতক উদ্ধারের ঘটনা। এদের কারো ঠাঁই হয় ডাস্টবিন, ফুটপাত, ড্রেন, হাসপাতালের করিডোরে কিংবা ময়লার স্তূপে। কিন্তু কেন? কী তাদের পরিচয়? আর রাতের আঁধারে কারাই বা ফেলে যাচ্ছেন তাদের? এসব নবজাতক কখনো মিলছে জীবিত, আবার কখনো মৃত। তবে এখন পর্যন্ত একটি ঘটনারও তথ্য উদ্ঘাটন হয়নি।

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী এসব ঘটনায় দায়ীদের খুঁজে বের করা কঠিন কাজ। রাজধানীতে গত দুই মাসে ডাস্টবিন ও ডোবা থেকে ৯ নবজাতক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। চলতি মাসেই মিলেছে পাঁচটি। ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গড় হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর বিভিন্ন স্থান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ৫০ থেকে ৬০ নবজাতকের ময়নাতদন্ত করা হয়।

পরিচয়হীন এসব নবজাতক উদ্ধারের বিষয়ে পুলিশ বলছে, জাতীয়ভাবে ডিএনএ ব্যাংক করা গেলে সহজেই পরিচয় জানা যাবে। সমাজবিজ্ঞানী ও আইনজীবীদের মতে, যে সংস্থাগুলো শিশুদের লালন-পালন করে, কথিত বাবা-মায়ের উচিত শিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দিয়ে সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত ৬ বছরে ২১০ জন নবজাতককে পরিত্যক্ত ও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম ১০ দিনেই উদ্ধার করা হয় ২০ নবজাতকের লাশ। গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে উদ্ধার করা হয়েছে ৪২ অজ্ঞাতনামা নবজাতকের লাশ। পুলিশ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ছয়টি ছোটমণি নিবাসে ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত চার বছরে ১০ হাজার ৮৯৮ জন পরিত্যক্ত শিশু আশ্রয় পায়। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি পরিত্যক্ত শিশু পাওয়া যায় চট্টগ্রামে ৩ হাজার ১৬২টি। তারপর সিলেটে ২ হাজার ৪৭৪টি। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা ১ হাজার ৫৩৬ শিশু। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, করোনাকালে পরিত্যক্ত শিশুপ্রাপ্তি চট্টগ্রামে ২১ শতাংশ, সিলেটে ১৯ শতাংশ এবং ঢাকাতে ২৫ শতাংশ বেড়েছে।

উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হামিদা পারভীন ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা ১০টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করি। পরিত্যক্ত শিশু সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় পায়। আমরা আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী বাচ্চাদের আশ্রয়ের ব?্যবস্থা করি।

সর্বশেষ গত রোববার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন সড়ক থেকে দুই নবজাতকের এবং মিরপুর দুই নম্বরের এক গলি থেকে আরেক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনটি মরদেহই কাপড়ে মোড়ানো ছিল।

পুলিশ জানিয়েছে, রোববার ভোরে শাহবাগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন সড়ক থেকে দুই নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে শনিবার বিকালে মিরপুর দুই নম্বরের এক গলি থেকে উদ্ধার করা হয় আরেক নবজাতকের লাশ। এর আগে সকাল সাড়ে ৮টায় শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসংলগ্ন কালীবাড়ি (পুরানবাজার) এলাকার একটি ময়লার স্তূপ থেকে শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে গত ৭ ফেব্রæয়ারি উদ্ধার হয়েছে এক নবজাতকের লাশ। নবজাতকটির বয়স আনুমানিক এক দিন। হাতিরঝিলের মহানগর প্রজেক্ট এলাকা থেকে লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ।

হাতিরঝিল থানার এসআই মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, মহানগর প্রজেক্ট এলাকার লেকের পাশ থেকে লাল রঙের শাড়ি পেঁচানো একটি ব্যাগ থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।

গত ৯ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পানির পাম্পের সামনে থেকে কাপড়ে মোড়ানো একটি নবজাতকের (মেয়ে) লাশ উদ্ধার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। গত ৫ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আরেকটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়।

ঢাকার বাহিরে, গত সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে লালমনিরহাট পৌরসভা এলাকার একটি ময়লার স্তূপ থেকে এক নবজাতককে (কন্যাশিশু) জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুটি বর্তমানে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।

এর আগে গত ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর শাহবাগের পরীবাগ এলাকার একটি বহুতল ভবনের সামনের ফুটপাথ থেকে মৃত এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। রাজধানী ঢাকার আজিমপুরে ইডেন মহিলা কলেজের সামনে রাস্তার পাশে ফুটপাথ থেকে এক কন্যাশিশু নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার হওয়া নবজাতক ও নবজাতকের বিষয়ে মামলা করেছে পুলিশ। মৃত নবজাতকের লাশের করানো হয় ময়নাতদন্ত।

গত বছরের ১৫ ফেব্রæয়ারি বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় বলাকা ভবনের পাশে একটি জঙ্গল থেকে জীবিত এক নবজাতক (কন্যা) সন্তান উদ্ধার করেছে পুলিশ। নবজাতকটি উদ্ধারের পর তাকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সর্বোচ্চ নবজাতক মৃত্যু-কবলিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশে প্রতি বছর জন্মের পর মারা যায় ৬২ হাজার নবজাতক। এসব শিশুর মৃত্যু হয় জীবনের প্রথম মাসে এবং অর্ধেকই মারা যায় ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার দিনই। বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরিণত অবস্থায় জন্ম, সংক্রমণ এবং ডেলিভারিকেন্দ্রিক জটিলতা থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতি। কিন্তু এগুলো অনেক সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসে না। তাই এসব প্রাণহানির কারণ থেকে যায় অজানা।

সমাজবিজ্ঞানী, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, সচেতনতার অভাবে অনাকাক্সিক্ষত সন্তান জন্ম নিচ্ছে। পরে লোকলজ্জার ভয়ে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। এই সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর তদন্তের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বিয়েবহিভর্‚ত অনেক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। ফলে এই নবজাতকদের জন্ম যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জীবন্ত শিশুকে ফেলে দিয়ে যাওয়ার ঘটনাও।

ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তারা বলেছেন, নবজাতকের লাশেরও ময়নাতদন্ত করতে হয়। তবে উদ্ধার হওয়া সব লাশের ময়নাতদন্ত হয় না। বেশির ভাগ রিপোর্টে ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার পরই হত্যার আলামত উল্লেখ করা হয়। এ শিশুগুলো সাধারণত প্রিম্যাচিউরড হয়। শরীরের টিস্যু বা হাড় সংগ্রহ করে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করে আমরা সিআইডিতে পাঠাই।

তিনি আরো বলেন, নবজাতকদের সঙ্গে ডিএনএ প্রোফাইল ম্যাচ করা আমাদের দেশে অসম্ভব। কারণ আমাদের ডিএনএ ব্যাংক নেই। এটি থাকলে অনেক অপরাধ কমে যেত।এদিকে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উদ্ধার করা নবজাতকদের ডিএনএ পাওয়া গেলেও তাদের মা-বাবার ডিএনএ স্যাম্পল নেই। তাই পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন) ফারুক হোসেন জানান, পরিত্যক্ত শিশুকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলে প্রথমেই পুলিশে জানানো হয়। মৃত হলে নবজাতকের লাশ ঢামেক হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। তাদের ডিএনএ টেস্ট করা হয় না। কারণ এ ক্ষেত্রে কখনোই নবজাতকের প্রকৃত বাবা-মাকে পাওয়া যায় না।

তিনি আরো বলেন, ঢামেক হাসপাতালের সনদ দেওয়া হলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে পাঠানো হয় দাফনের জন্য। আর জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেলে আমরা নবজাতকের পাওয়ার খবর টিভি চ্যানেলে স্ক্রলে দিয়ে দেই। কোনো অভিভাবক না পাওয়া গেলে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে দেওয়া হয়।

মন্তব্য

Beta version